“না, আমি এসেছিই এইটাতে থাকার উদ্দেশ্যে,” বললেন প্রফেসর আব্রাহাম।
- আমি জানি স্যার, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আপনি ওসব বিশ্বাস করেন স্যার? এটা অনর্থক চিন্তা হয়ে যাচ্ছে না?
কট করে প্রফেসর তাকালেন এ্যাড -এর দিকে। তাঁর চাউনি দেখেই এ্যাড বুঝলো মস্ত বোকামি করে ফেলেছে, প্রফেসরকে রাগানো একদমই ঠিক হয় নি।
- নিজেকে খুব আধুনিক মনে করো, তাই না?
- না, মানে স্যার...
- চুপ কর, তুমি আমার কাছে ফিলোসফি ডিগ্রি নিচ্ছো, আমি না।
- দুঃখিত স্যার, ভুল হয়ে গেছে।
- আচ্ছা, আধুনিক এ্যাড, দেখি তো তোমার বুদ্ধির বহর; বলো তো পিরামিডের পাথরের তেজস্ক্রিয়তা অনুসারে পিরামিডগুলো কোন যুগের?
- হাফ লাইফ অনুসারে প্লিস্টোসিন যুগের; দশ লক্ষ বছর আগের স্যার।
- অথচ ধর্মগ্রন্হ অনুসারে আমরা কি জানি? ওগুলো কারা তৈরি করেছিল?
- ফারাওরা স্যার.... কয়েক হাজার বছর আগে।
- তাহলে এখান থেকে তুমি কিভাবে বুঝবে কোনটা সত্যি? তোমার ধর্ম নাকি বিজ্ঞান? দশ লক্ষ বছর আগে মানুষের সামাজিক জীবন মাত্র শুরু হয়, তখন পিরামিড বানানোর প্রশ্ন ই উঠেনা তাদের পক্ষে; ফিনীশিয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম সভ্যতা আসে, তারাও বানায় নি, কারণ তারা মিশরে আসেই নি কখনও; তাহলে ফারাওরা যদি বানিয়েই থাকে তাহলে তারা প্রতিটা চার টনের পাথর কিভাবে শত শত ফুট উঁচুতে ওঠালো যেখানে আজও আমরা এক টনের বস্তু একশো ফুট ওঠাতেই হিমশিম খাই তাও আবার সেই যুগে কপিকল এর আবিষ্কারই হয় নি?
- হয়তো বা প্রকৃতির খেয়ালেই গড়ে উঠেছে স্যার।
“গর্দভ..”, চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, “প্রকৃতি কখনোই সরলরেখা তৈরি করতে পারে না। আমিও ধর্মভীরু, তবে এখনও অনেক কিছুরই হিসেব পাই না।”
এ্যাড চুপ করে গেলো; বুঝেছে প্রফেসরের সাথে পেরে উঠবে না। মিন মিন করে বললো, “তাহলে কারা তৈরি করেছিলো?”
- সেটা সময় হলেই জানতে পারবে, জানার জন্যই তো এসেছি।
প্রফেসর তাড়া দিলেন, “জলদি মালপত্র ঢুকাও; সন্ধ্যা হয়ে আসছে।” এ্যাড মনে মনে ভাবলো, আচ্ছা পাগলের হাতে পড়েছে; সকল বিশ্বাসেই অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয় আব্রাহাম নামের এই পাগল প্রফেসর। উনি ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তাত্বিক বিভাগের প্রফেসর।
তথাকথিত গল্প আর মুভিতে পিরামিডের ভেতরের দৃশ্য যতটা জাঁকজমক করে দেখানো হয় মোটেই সেরকম লাগলো না এ্যাডের কাছে এই পিরামিড এর ভেতরটা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার; প্রফেসর ব্যাটারিচালিত লাইট জ্বাললেন। কে জানে হয়তো পিরামিড তৈরির পর এই প্রথম এর ভেতরে ইলেকট্রিক বাতি জ্বললো; দুটো টর্চ নিয়ে আব্রাহাম ও এ্যাড ভেতরের দিকে চললেন।
একটা ব্যাপার ভীষণ অন্যরকম লাগলো এ্যাড এর কাছে; সারাদিন এই অঞ্চলে হাজার মানুষের আনাগোনা, অথচ আধাঁর হতেই সব নিশ্চুপ। একজন গাইডকে তাদের সাথে রাত কাটাতে বলায় বিস্ফোরিত চোখে মিনিট দশেকের মধ্যেই তাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে কেটে পড়েছে। ঘুপরির মত ঘরে কয়েকটা পাথরের কফিন ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না। ওগুলোতে মমি রাখা তবে পাথরের ঢাকনি দেয়া, দেখা যায় না।
প্রফেসর নিচের দিকে পা বাড়ালেন। পিছু পিছু এ্যাড যাচ্ছে; অনেকগুলো সুরঙ্গ দেখা গেলো, ছাত অনেক নিচু। প্রফেসর কি যেন হিসেব করে তিন নম্বরটায় ঢুকে পড়লেন। মিনিট খানেক হাঁটার পর তারা একটা দেয়ালের সামনে যখন আসলো তখন প্রফেসর এ্যাডকে বললো সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলা দিতে। পাগল নাকি!! এই পাথরের দেয়াল মানুষের ধাক্কায় বুঝি সরবে? তবুও, কথা মানার ছলে ধাক্কা দিতেই খড়খড় করে দরজার উদয় হলো যেন। এ্যাড অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে রইলো, এই ৫৭ বছরের বুড়ো দেখছি অনেক বেশি ই জানে; তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার উদয় একটু বেড়েই গেলো এ্যাডের মনে।
রুমে ঢুকতেই এ্যাড থমকে দাঁড়ালো। পুরো রুমে একটাই বিশালাকার কফিন, পাথরের গায়ে নকশা আঁকা। প্রফেসর বললেন, “এই সেই ফারাওর মমি যে হার্পির প্রেমে পড়েছিল, মিশরীয় সম্রাট স্যাড -ডে। হার্পি ওকে মায়াজালে জড়িয়ে হত্যা করেছিলো।”
এ্যাড বললো, “কিন্তু হার্পি তো গ্রিক দেবতার সময়কার ডাইনী ছিলো।”
- হ্যাঁ, কিন্তু ও মায়াজাল বিস্তার করতে পারে আজও... ফারাওর সময়ে মিশরে এসেছিল। আজও ও আছে, এখানেই থাকতে পারে, সুপ্তাবস্থায়, পুরুষ দেখলেই ও জাগ্রত হয়ে ওঠে।
চোখ কপালে উঠলো এ্যাডের, কি বলে প্রফেসর!! এখনকার দিনে এসবের অস্তিত্ব আছে নাকি!! ছাত্রের মনের কথা ধরে ফেললেন প্রফেসর; শীতল গলায় বললেন, “আমি যা বলছি তাই সত্যি এ্যাড।” মনে মনে মানতে না পারলেও নিঃশব্দে মাথা নাড়লো সে।
প্রফেসরের দৃষ্টি ঘুরলো ঘরের মধ্যে, অসংখ্য পিতলের মূর্তি; তর্জনী উঁচু করে ঘরের কোণার দিকে এ্যাডকে নির্দেশ করলেন। প্রায় মানুষের সমানই এক শ্বেতপাথরের তৈরি নগ্ন নারীমূর্তিকে দেখতে পেলো এ্যাড। বিকট দৃষ্টি তার চোখে, তার পিঠে বিশালাকায় কাঁটাযুক্ত দুটো পাখনা, হাত ও পা পাখির মত ও বড় বড় সূচালো নখরযুক্ত। মুখটা সামান্য হা করা, ভেতরে শ্বদন্ত দেখা যাচ্ছে অল্প পরিমাণ। এক দেখাতেই এ্যাডের মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো একটা শব্দ, “হার্পি!”
প্রফেসর বললেন, “জানি তুমি গথিক এ বিশ্বাস কর না, কিন্তু দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর সকল গথিকেই এসবের ব্যাখ্যা দেয়া আছে, আজও উত্তর আমেরিকা, কলোম্বিয়া, আফ্রিকায় প্যাগনাররা ফেটিশ চর্চা করেন; আজও আইরিশরা লেপ্রেকনে বিশ্বাস করে; স্কটল্যান্ডের আদিবাসীরা ব্যানশী কে ভয় করে। আজও চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় যে সম্মোহিত অবস্থায় মারা গেলে আত্মা দেহে সুপ্ত থেকে যায়, বছরের পর বছর কাটে, লাশের দেহ পঁচে না, বরং লাশের নখ আর চুল বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদের বিশ্বাস অনর্থক নয়।”
চুপ করে রইলো এ্যাড, সে চারদিকে তাকাতে লাগলো, অসংখ্য মূর্তি চোখে পড়লো। গ্রিক পুরাণের গোগ্রান, খুদে পিক্সি, প্রাচীন গ্রিসের ঔগার, খুদে শয়তান পাক্, চোখে পড়লো ঘুমন্ত মূর্তির বুকের উপর ইনকিউবাস নামের চেপে থাকা বিকট মূর্তি, মড়া খেকো গূল, আরো অসংখ্য বিকটাকৃতির ছোট বড় মূর্তি। এ্যাডের শিরদাঁড়ায় একটা স্রোত নামলো যেন; প্রফেসরের সাথে আগামী এক মাস এইখানে থাকার কথা পাগলের কান্ড বলে মনে হলো কেন যেন!!
পরের সারাটা দিন প্রফেসরের সাথে বিশাল ঘরটার সব কিছু খুটিয়ে দেখলো এ্যাড; সন্ধ্যা হতেই অস্বস্তি শুরু হলো। প্রফেসরের কোনোদিকেই খেয়াল নেই, সারাদিন এ্যাডকে ডাকই দিলেন না, সন্ধ্যার কিছু পরে বললেন, “এ্যাড, আর্ক অব মুসার কথা মনে আছে তোমার? যেটার ভেতরে থাকা বুক অব মনমরের জন্য রোমান ও ক্যাথলিকরা যুদ্ধ করেছিলো? ওটার ভেতরে পিরামিড এর নির্মাতার নাম ছিলো কিন্তু যেটার জন্য যুদ্ধ সেটাই পরে পাওয়া যায়নি।”
- হ্যাঁ স্যার, মনে আছে, কেন?
- বুক অব মনমরের প্রথম পাতায় কি লেখা ছিলো বলে তুমি জানো?
- মৃত্যুতেই জীবন শুরু...
- এসো আমার সাথে...
এ্যাডকে প্রফেসর শ্বেতপাথরের সেই নগ্ন নারীমূর্তির সামনে নিয়ে এলেন; মূর্তির বেদীতে লেখা পড়তে বললেন এ্যাডকে। এ্যাড দেখলো, হায়ারোগ্লিফিক্স পদ্ধতিতে লেখা হয়েছে, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে প্রফেসরের দিকে তাকালো সে।
- কি দেখলে?
- মৃত্যুতেই জীবন শুরু...
ধ্বাতস্থ হয়ে এ্যাড বললো, “কিন্তু এতে তো প্রমাণ হয় না যে হার্পি নিজে এই পিরামিড গুলো তৈরি করেছে।”
- যা বলেছো... তবে সেটাই এখন আমাদের বের করতে হবে।
সেদিন রাতে ভাল ঘুম হলো না এ্যাডের, হার্পির মূর্তিটাকে কেন জানি জীবন্ত মনে হয় ওর কাছে।
দুদিন পর প্রফেসর দৌড়ে আসলেন এ্যাড -এর কাছে, ফিসফিস করে বললেন, “ও বলেছে আমাকে বলবে সব, ও বলবে সব, সব...”
কি ব্যাপার? প্রফেসর এমন পাগলের মত আচরণ করছেন কেন? এ্যাড দুদিন ধরে লক্ষ্য করছে উনি কথা বলেন না, খান না, সারাদিন হার্পির বেদীখানায় হায়ারোগ্লিফিক্স লেখাগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন। সপ্তাহের শেষ দিকে এ্যাড হাঁপিয়ে উঠেছিল, তার স্যার সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছেন, তার সামনে গেলেই ফিসফিস করে বলেন, “ও আমাকে ভালোবাসে, সব গোপন কথা আমাকে বলবে বলেছে... ও আমাকে ফিনিক্স এর কথা বলেছে, ওরা কিভাবে হাজার বছর আরব্য মরুভূমিতে বাঁচার পর নিজেদের চিতাগ্নিতে পুড়িয়ে মেরে ফেলে সব বলেছে,সব... পিরামিড কে বানিয়েছে সেটাও বলবে ও... সব বলবে, কেননা ও আমায় ভালোবাসে...”
হার্পি কি প্রফেসরের উপর মায়াজাল সৃষ্টি করেছে?শীতল স্রোতটা আবার নামলো দেহে। ধুর!! কি ভাবছে!! ভাবলো এ্যাড, প্রফেসর অতিপ্রাকৃতিতে বেশি বিশ্বাস করায় তাঁর মাথাটাই গেছে; বুড়ো বয়সে ভীমরতি পেয়েছে; এখন আগামী তিন সপ্তাহ কাটলেই এখান থেকে বের হলেই বাঁচি। কেননা একমাসের রিসার্চেই ওরা এসেছে। সেদিন রাতেই ঘটলো ঘটনাটা। সারাদিন স্যারের সামনেই যেতে পারে নি এ্যাড, কি কারণে জানি পাশের ঘরে এ্যাডকে বসিয়ে রেখেছেন উনি।
মাঝরাতের দিকে অসহ্য লাগছিলো সব কিছু এ্যাডের কাছে, ঘুম আসছিলো না, খুব শীত লাগছিলো, স্যার এর সাথে একটু কথা বলা দরকার।
মূল ঘরটাতে ঢুকতেই এ্যাড দেখলো ঘরটা পুরো অন্ধকার, টর্চ এনে জ্বালতেই দেখলো শ্বেতপাথরের হার্পির মূর্তিটা নেই, শূণ্য বেদীটা পড়ে আছে, ধ্বক্ করে উঠলো বুকটা। দ্রুত চোখ বোলালো ঘরটায় এ্যাড, কোথাও প্রফেসর নেই। সামনের দিকে বাড়লো এ্যাড, কোথায় জানি শব্দ শোনা যাচ্ছে, বেদীর উপর আবার টর্চ ফেললো এ্যাড, ওর কলিজাটা লাফ দিয়ে উঠলো, পা দুটো অবশ হয়ে এলো।
বেদীর উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন প্রফেসর আর তার বুকের উপর শুয়ে আছে একটা নগ্ন নারী, টর্চের আলোয় ঝট করে এ্যাড এর দিকে তাকালো নগ্নিকা নারীটি; তার চোখে মণি নেই, সম্পূর্ণ সাদা, মুখটা অসম্ভব বিকৃত, এ্যাড এর দিকে তাকাতেই হাত থেকে টর্চ পড়ে নিভে গেলো, ঘরটাতে কোথা থেকে যেন আবছা আলো ছড়াচ্ছে। আর সেই আলোতে দেখলো নারীটির আরো বিকৃত রূপ। এ্যাডকে দেখে সাপের মত হিসিয়ে উঠলো ও, গলা থেকে বেরিয়ে এলো এক ফুট লম্বা লাল টকটকে জিহ্বা; জিহ্বাটার সামনের দিক সাপের জিভের মতো চেরা, লিকলিকিয়ে উঠলো জিভটা। তারপর ভয়ংকর এক ডাক দিয়ে পাখির মত বিশাল ডানা ঝাপটিয়ে ছাতের দিকে উড়ে গেলো।
এ্যাড হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলো মেঝেতে; হামাগুড়ি দিয়ে কোনক্রমে বেদীর সামনে পৌঁছে প্রফেসরের দিকে তাকাতেই দেখলো তাঁর মুখটা ঈষৎ হা করা, বিস্ফোরিত চোখ খুলে আছে, চোখে মণি নেই। ঠিক তখনই এ্যাড এর মস্তিস্ক প্রবল নাড়া খেলো, জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মূহুর্তে হাজারো ফিনিক্সের কন্ঠে শুনতে পেলো, “মৃত্যুতেই জীবন শুরু... মৃত্যুতেই জীবন শুরু...”
No comments:
Post a Comment