মানব কুকুর


পিঠটা খুব জ্বলছে ফিরোজের। বেতের বাড়িগুলো খুব লেগেছে। বাপ মা নাই বলে এতিমখানায় যা ইচ্ছে তাই করবে বুঝি হারামজাদা টিচারগুলো?

কি দোষ ছিলো তার?

পড়াটা মুখস্ত করেনি, এই তো?

তাই বলে এমনভাবে মারবে? চুলোয় যাক অমন প্রতিষ্ঠান। ভিক্ষা করে খাবে তাও এতিমখানায় ফিরবে না আর। যদিও এখন পর্যন্ত ভিক্ষাও জোটে নি।

দ্বিতীয় দিনের মত প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে এসব কথাই ভাবছিলো ফিরোজ। একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ও। ছয়তলা বিল্ডিং এর প্রকান্ড গেইট এর ফাঁক দিয়ে ওর চেয়ে ছোট এক ছেলেকে দেখতে পেলো ফিরোজ। কত বয়স্ক মানুষের কাছেই তো খাবার চাইলো, দেখা যাক এই পুঁচকেটাকে মানিয়ে পেটটা বাঁচানো যায় কি না।

ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকে বাচ্চাটার সামনে গিয়ে কাঁচুমাঁচু গলায় বললো,
- ভাই, দুইডা দিন ধইরা না খাইয়া আছি...

- তো?

- কিছু টেকা দেন ভাই। আর পারতাছি না। 

- আমার সামনে থেকে যা। টাকা নাই। 

বয়সে ছোট হলেও ছেলেটা ফিরোজকে তুই করেই বললো। দুর্বলের প্রতি সবলের যা স্বভাব আর কি!!
- ভাই দয়া করেন। মইরা যামু পেডে কিছু না পড়লে। টেকা না দেন, দুগা ভাত দেন ভাই, পায়ে ধরি ভাই, দয়া করেন।

- আম্মু বাসায় নাই। আর ঘরে তো ভাতও নাই। আমরা সকালে ব্রেড খাই।

- কাইল রাইতে তো খাইছেন ভাই। বাঁচে নাই ওইখান থেইকা? এক মুঠা হইলেও হইবো ভাই।

- না রে, নাই তো...

- ভাত না থাকলে ভাতের ফেনই দেন ভাই। আর পারতাছি না।

ছেলেটা হো হো করে হেসে বললো,
- মানুষ ফেন ও খায়? জানতাম না তো!!

- আমার মত মাইনষেরা খায় ভাই।

ছেলেটা হাত দিয়ে ইশারা করলো ফিরোজকে এক কোণায়। একটা ছোট ঘর, কুকুরের।
- ফেন তো ওকে খাইতে দেই আমরা।

- ভাই, আমি ফেনটা খাই?

ফিরোজের চোখে আকুতি দেখে দয়া হল ছেলেটার।
- আচ্ছা খা, এক বেলা ওর কম হলে কিছু হবে না। তবে পরের বার আর এইখানে যেন না দেখি।

‘আইচ্ছা’… বলে দৌড়ে ফেনের পাত্র টা তুলে নিলো ফিরোজ। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। তবে ওটা শিকল দিয়ে বাঁধা। পাত্রটাতে কুকুরের বিষ্ঠার তীব্র পঁচা গন্ধ। ফিরোজের ভ্রক্ষেপ নেই সেদিকে। পেট বাঁচানো ফরয। ঢক ঢক করে গত রাতে রেখে দেয়া সবটুকু খেয়ে নিলো ও। কুকুরটা সারারাতে সব শেষ করতে পারে নি। 

পরের দুইদিন এভাবেই ক্ষুধার্ত রইতে হলো ওকে। না খাওয়ার যন্ত্রণা কয়দিন আর সহ্য করা যায়? অগত্যা এতিমখানায়ই ফিরে যেতে হলো। তবে তার জন্য উপযুক্ত সম্মানও পেতে হল ওখানে।
.
.
.
কাল রাতে ধুম বৃষ্টি হয়ে গেছে।

ঘুপচি তিনতলা বাড়িটা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন ফিরোজ মাস্টার। তিনতলার একদম নিচের তলার ছোট্ট একটা ঘরে ভাড়া থাকেন উনি। যে এতিমখানায় মানুষ হয়েছেন, তিরিশ বছর ধরে সেই এতিমখানাতেই শিক্ষকতা করছেন। বেতন আর কত হবে!! এতিমখানারই তো যায় যায় অবস্থা। ছয় হাজার টাকা বেতন। বাড়ি ভাড়া গুনতেই লাগে চার হাজার। ঢাকা শহরে দু-হাজার দিয়ে তিনবেলা পেট পুরে খাওয়া কল্পনাতীত।

গায়ে তৃতীয় বার রিপু করানো পান্জাবীটা পড়লেন। যে কোনোদিন খালি গায়েই হয়তো ক্লাসে যেতে হবে। বাচ্চা কাচ্চা নেই, বউ বাঁজা ছিলো। বারো বছর আগে ক্যান্সার হয়ে উপরে চলে গেছে। এই যা রক্ষা! নাহলে আরেকটা মুখের খাবার জোটানো দুঃসহ হয়ে যেতো।

একমাত্র ফিরোজ মাস্টারই বারবার চেয়েও উপরে যেতে পারেন নি। 

রাস্তার ওপারে চিরচেনা মজনু ভিক্ষুককে দেখতে পেলেন ফিরোজ মাস্টার। দুই পা নেই বৃদ্ধের। খালি গা। চেহারা দেখেই বোঝা যায় সারারাত বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। হাতে দুইটা তক্তা নিয়ে ঘষে ঘষে চলাফেরা করে মজনু। 

রাস্তাটা মোটামুটি বড় হওয়ায় আর সকালে গাড়ি না থাকায় অনেকেই মর্নিং ওয়াকে বের হয়। এক তরুণীকে কুকুর হাতে ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে কুকুরটার খাবার নিয়ে বের হতে দেখলো মজনু। 

- আম্মা, দুইডা টেকা দ্যান...

- উফ্...সকাল সকাল ঝামেলা। টাকা নাই, যাও।

- আম্মা, দেন না? এমন করেন ক্যান? আফনেরা না চাইলে কেডায় দিবো আমগোরে? আল্লারস্তে দ্যান মা...

- আরে বাবা, বললাম তো নাই।

- কুত্তার লিগা এত টেকার খাওন কিনতে পারেন আর এই বুড়া মানুষডারে দয়া করবার পারেন না?

গর্জে উঠলো মেয়েটা,
- কি বললি তুই? এইটা কুত্তা?

- কুত্তাই তো। ওইডার লাহানই তো দেখতে। 

- রাবিশ্.. তোর মত একশটা ভিক্ষুকরেও বেঁচলেও এইটার দাম উঠবেনা। বুঝছিস? সর হারামজাদা। 

গটগট করে তরুণী চলে গেলো। মজনু ভিক্ষুকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কুকুরটা গরগর করে উঠলো। ভয়ে মজনু পিছনে সরে গেলো।

ফিরোজ মাস্টার জানেন, ওটা আ্যালসেশিয়ান। মজনুর নির্বাক চোখে পানি দেখতে পেলেন ফিরোজ মাস্টার।

ডাস্টবিনে চোখ পড়লো মাস্টারের। একটা ফেলে দেওয়া চ্যাপ্টা ভাঙা পাত্রে কিছু শুকনো ভাতের ফেন বৃষ্টির পানিতে তরলে পরিণত হয়েছে। একটা নেড়ি কুকুর জিভ বের করে চুকচুক করে খাচ্ছে সেটা। ছেলেবেলার কথা মনে পড়লো মাস্টারের। উপরের দিকে চাইলেন উনি। ঢাকা শহরে নীল আকাশ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার।

চারপাশে বিশাল বিশাল উঁচু দালান। এত বড় দালানের সামনে তার মত অসহায় মানুষ আর রাস্তার কুকুরদের মধ্যে ফারাক খুঁজেন তিনি। কোনো ফারাক পান না। কুকুরদের তো জাত আছে। কুত্তা বলে ডাকা হয়। তাহলে তার মত অসহায়দের কি নামে ডাকা উচিত?আবার উপরে তাকিয়ে উত্তর খুঁজেন ফিরোজ মাস্টার। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে একটা শব্দই আসতে থাকে-“মানব কুকুর।”

বাড়ি ফেরার গপ্পো


মসজিদ থেকে ভেসে আসা তীব্র শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জাগলাম। সেহরির সময় হয়ে গিয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের যন্ত্রণাটাও বেড়েছে। এই গরমেও কেনো জানি না ঠান্ডা লাগছে। অনেক্ষণ চুপ করে বসে থেকে যখন ভাতের হাড়ির দিকে হাত বাড়ালাম,অনুভব করলাম,সেটা খালি। পাশে দু মুঠো মুড়ি পড়ে আছে পলিথিনে। হাত বাড়িয়ে পলিথিনটা আর পানির বোতলটা টেনে নিলাম নিজের দিকে।

আজ বেশ আগেভাগেই বাসা থেকে বের হয়েছি। যখন ফ্যাক্টরি তে পৌঁছলাম,তখন বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়ি চোখে পড়লো। একটু এগোতেই দেখি,বেদম মারামারি চলছে। শ্রমিকদের সাথে নাকি বেতন ও ঈদ ভাতা নিয়ে ঝামেলার কারণে ফ্যাক্টরি বন্ধ। তার মানে বেতনের আশাও শেষ। শূন্য পকেট,সামনে সংঘর্ষ,বেতনহীন সময় ও বাড়ি ফেরার স্বপ্ন। গ্যাস্ট্রিক আর পরিবারের স্বপ্নীল চাহুনির চিন্তায় ধপ করে বসে পড়লাম কংক্রীটের রাস্তায়।

গত দুই মাস ধরে খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে জমানো যা কিছু টাকা ছিলো,বাড়ি ফেরার ভাড়া রেখে বাবা মা আর ছুটকির জন্য কিছু টুকটাক জিনিস কিনলাম।  ঈশাতের জন্য এক জোড়া কানের দুল কিনেছি। বাস স্টেশনে এসে টিকেট কিনে অপেক্ষা করছি। একটা লোক পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
-কই যাইবেন ভাই?

-সিলেট।

-ও...আইচ্ছা....

লোকটার সর্দি লেগেছে বুঝা যাচ্ছে। চোখও লাল। পকেট থেকে নাক মোছার জন্য লাল রুমালটা বের করে ঝাড়া দিয়ে ভাঁজ করলো। আমার আর কিছু মনে নেই।
.
.
.
মাগরিবের আজানে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি আমার সাথে কিছুই নেই। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। অনেক কস্টে পানি খেয়ে ইফতার করলাম। মাথাটা শূন্য লাগছে,চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। গত ৩বছর বাড়ি যেতে পারিনি কোনো না কোনো কারণে। খুব আশা ছিলো এবার বেশ ঘটা করে বাড়ি ফিরবো।

হলো না।

মহাসড়কে বেশ ভীড়। গাড়ি বোঝাই শুধু মানুষ আর মানুষ। কাল ঈদ। চোখে ঝাপসা দেখছি সব। মা বাবা ছুটকি আর ঈশাতের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। শরীরটা ভেঙ্গে আসছে। মায়ের মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। গ্রামের বাড়ি স্কুল মাঠ বাজার সব কিছু চোখে ভেসে উঠছে। স্রোতের মত মানুষ চোখের সামনে দিয়ে বাসায় ফিরছে। বুকটা ধ্বক্ করে উঠলো। সবাই যে বাসায় আমার জন্য আকুল দৃষ্টিতে বসে আছে।

আমায় বাড়ি ফিরতেই হবে। মাথায় কিচ্ছু নেই। যেভাবেই হোক,ফিরতেই হবে।

সিলেটগামী ট্রাকে চেপে বসলাম। শুধু অনুভব করছি,দ্রুত ঢাকা থেকে সরে যাচ্ছি। মাঝরাতে যখন ভাড়া চাইলো,ভাড়া দিতে না পাড়ায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার কথা বলেও নামায়নি। হয়তো ঈদ বলে,নয়তো শরীরের অবস্থা দেখে।

ভোর বেলা সিলেট এসে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে পারছিলাম না। চারদিকে ঈদের খুশি দেখে জোড় ফিরে পেয়েছি। আমার গ্রাম একটু ভিতরেই। টলতে টলতে হাঁটা দিলাম। যখন গাঁয়ে ফিরলাম,সবাই ঈদের নামাজ পড়ে ঘরে ফিরছে। ছোট চাচা ও আরো কয়েকজনের সাথে দেখা হয়ে গেলো। চিৎকার করে এসে জড়িয়ে ধরলো সবাই। আমার শরীরও হাল ছেড়ে দিলো।

যখন ঘুম ভাঙলো,চেয়ে দেখি মা কাঁদছে। বাবা মাথায় হাত বুলোচ্ছে। ছুটকী পায়ের কাছে বসে আছে। চাচা-চাচী পাশেই দাঁড়িয়ে। সবার চোখেই জল। আমার চোখ জ্বলছে। কাউকে খুঁজছি আমি,সেটা সবাই ই বুঝেছে। জোর করে ঘুমোনোর কথা বলে একে একে বেড়িয়ে গেলো সবাই।

যখন চোখটা বন্ধ করলাম,টের পেলাম রুমে কেউ ঢুকেছে। অনেক কস্টে তাকিয়ে দেখি,ঈশাত। গত তিন বছরে ওর রূপ যেন আরো বেড়ে গিয়েছে। ওর চোখের কোণায় জল যেন ওকে অপ্সরী করে তুলেছে।
ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম,
-তোমার জন্য দুল কিনেছিলাম। চোর নিয়ে গ্যাছে।

কিছুই বললোনা ও। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে যখন আমার কপালে পড়লো,ঈশাত ওর ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল। চোখে পড়লো ওর কানে এক জোড়া সোনার দুল।

চিনতে পারলাম।

মা তার ছেলের হবু বউকে বিয়ের আগেই ঈদ উপলক্ষ্যে নিজের দুলজোড়া উপহার দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসার আগেই প্রচন্ড ঘুম ধরে এলো চোখে। বুঝলাম,আমার বাড়ি ফেরার গপ্পো শেষ হয়েছে।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে টের পেলাম,ঠোঁটের কোনায় আমার এক চিলতে হাসি।

চন্দ্রিমা...


চন্দ্রের ১৭ তম দিন।
পূর্ণ জ্যোছনায় জন্মেছিল অপরূপ রূপসী কন্যা;দেহ ঠিকরে চাঁদের জ্যোছনার বান ডাকায় নাম হয়েছিল চন্দ্রিমা। মরণপুর গ্রামের রাজকন্যে। চন্দ্রদূত যেন চন্দ্রপুরী যাওয়ার পথে মর্তে ভুলে ফেলে গিয়েছিল তাকে।

চন্দ্রিমার বয়স এখন সতের। মাঝরাতে ঠিক মাঝআকাশে যখন পূর্ণ চাঁদটা উঠে,চন্দ্রিমার তখন মাঝঘরে থাকা দায় হয়ে যায়। ত্রাতুলের জন্য তার মন শুধুই আনচান করে। দুজনেই উত্তরের বাঁশবাগানে ছুটে আসে। সবুজ ঘাস বিছানো জমিতে বসে বাঁশঝারের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক দিয়ে বিশাল আসমানে হালকা মেঘে ঘেরাও করা গোল চাঁদটা দুজনেই অবলোকন করে শুধু। ঠিক যেন চাঁদ আর দুজন মানবের মধ্যে ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক। রুক্ষ হাতের মসৃণ দেহ আদর সূক্ষ্ম সাম্যাবস্থা বজায় রাখে;অশালীনতা পাহারা দেয় চন্দ্রদূত।

কিন্তু চন্দ্রদূত বেশিদিন পাহাড়া দিতে পারলোনা। সামনের বৈশাখে চন্দ্রিমার বিয়ে। দুজনের একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়;অস্পৃশ্যতার বাঁধনে বাঁধা তারা। চন্দ্রিমার মত ত্রাতুলের জীবনেও বৈশাখের ঝড় চলছে। চন্দ্রিমা ঘরে বন্দি। তিনটে চন্দ্রমাস পেরিয়ে গেলো,অথচ দুজনের দেখা নেই। ত্রাতুলের জন্য সে এখন অস্পর্সী।

চন্দ্রের ১৭তম রাত। জানালার গরাদ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ও। জোছনার ঢলের মত চন্দ্রিমার চোখ দিয়ে ঢল নেমেছে। মনে পড়ছে অতীত।

-আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো তো?

মুচকি হেসে ত্রাতুল বলেছিল,
-চুরাশি লক্ষ হাজার বার জন্মাবো,প্রতিবারই জোড়া বেঁধে থাকবো।

-হুঁম,মরণের ওপারেও একসাথেই থাকবো।

একথা বলে খিলখিল করে হেসে দিয়েছিল ওরা। 

বিরহে চন্দ্রিমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে। ত্রাতুলকে ছাড়া তার টিকে থাকা অসম্ভব। কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের প্রান্তে থাকা মজিদের গানের গলা। প্রচন্ড কষ্টে খাটের নিচে রাখা সাদা দড়িটা দেখে মুচকি হাসি হাসলো চন্দ্রিমা। ধীরে ধীরে দড়িটা ছাদ থেকে ঝুলিয়ে নিপুণ একটা ফাঁস তৈরি করলো সে।
.
.
.
তিনটে বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সাথে সাথে ত্রাতুলের পাগলামিও বেড়ে চলেছে। প্রথম দিকে ভালবাসার কান্না কাঁদলেও যে চন্দ্রিমাকে সে এত ভালবাসতো;আজ তারই নাম আর তার মৃত্যুর কথা শুনলে বরং সে খুশিতে হাসে আর পাগলের মত আচরণ শুরু করে। চন্দ্রিমা নাকি মরেনি। এখন নাকি সে প্রতিরাতেই তার ঘরে এসে বলে 'নিঁম,নিঁম'।

প্রচুর কবিরাজ বৈদ্য দেখানো হয়েছে। লাভ হয়নি। বরং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। দূর গায়ের এক ওঝা বলেছিল,'নিঁম' মানে 'নিয়ে যাব'। অর্থ জানতে পেরে খুশিতে নেচেছিল সেদিন ত্রাতুল। পাগলামীর কারণ হিসেবে ওঝা বলেছিল,ত্রাতুলের গায়ে খারাপ বাতাস লেগেছে। ওর কলিজা নাকি পুরোটাই কোনো খারাপ বাতাসে খেয়ে ফেলেছে। 

সময় বেশি নেই। একথা শুনে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়েছিলো ত্রাতুল।
.
.
.
চন্দ্রের ১৭তারিখ। 

বাইরে জ্যোছনার ঢল নেমেছে। 

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ত্রাতুল। আসমানের দিকে একবার তাকিয়ে উত্তরের বাঁশবাগানে ওদের সেই প্রেমস্থানে এলো ও। তবে আজ গন্তব্য আরো সামনে। উত্তরের জংলা নির্বিকারে পেরিয়ে এলো। জংলার ওপারে শ্মশানে এসে থামলো ও। শ্মশানে কোনো জাতের প্রভেদ নেই। সবারই মিলনস্থল। মড়া পোড়ানোর ঢিবির উপর চন্দ্রিমা বসে আছে। দুজনেই দুজনকে দেখে হাসলো।

চন্দ্রিমা বললো,
-আজ তোমায় নিতে এসেছি। তোমায় মরণের ওপারে নিয়ে যাবো।

-কিন্তু কিভাবে যাবো তোমার সাথে?

চন্দ্রিমা মুচকি হেসে আঙ্গুল দিয়ে ত্রাতুলকে বটগাছটা ইঙ্গিত করলো।
বটগাছের দিকে তাকালো ত্রাতুল। ফাঁসির দড়িতে চন্দ্রিমা ঝুলছে। খুলে থাকা চোখ দুটো প্রচন্ড যন্ত্রণায় ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। থুতনি পর্যন্ত জিহ্বাটা বেড়িয়ে এসেছে। তাতে দুই কপাটির দাঁতেরই তীব্র কামড় বসে আছে। বটগাছের ডাল থেকে ফাঁসির দড়িতে চন্দ্রিমার দেহটা মৃদু বাতাসে মৃদু দুলছে। 

পিছনে মড়া পোড়ানোর ঢিবিটার দিকে তাকালো ত্রাতুল। চন্দ্রিমা বসে আছে,আর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ত্রাতুলও একচিলতে হাসি দিয়ে সামনে তাকালো। বটগাছের ডালে সাদা একটা দড়ি ঝুলছে।
.
.
.
ত্রাতুল ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে চাঁদটা। ক্রমশ অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসার সাথে সাথে গ্রামের প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মজিদের করুণ গলার সুর-
                                        'ভালবাসার মান জানিনা,
                                            জোড়া বেঁধে রই;
                                        নিঠুর তোর পথে আসছি,
                                            সখীরে তুই কই?'