চন্দ্রিমা...


চন্দ্রের ১৭ তম দিন।
পূর্ণ জ্যোছনায় জন্মেছিল অপরূপ রূপসী কন্যা;দেহ ঠিকরে চাঁদের জ্যোছনার বান ডাকায় নাম হয়েছিল চন্দ্রিমা। মরণপুর গ্রামের রাজকন্যে। চন্দ্রদূত যেন চন্দ্রপুরী যাওয়ার পথে মর্তে ভুলে ফেলে গিয়েছিল তাকে।

চন্দ্রিমার বয়স এখন সতের। মাঝরাতে ঠিক মাঝআকাশে যখন পূর্ণ চাঁদটা উঠে,চন্দ্রিমার তখন মাঝঘরে থাকা দায় হয়ে যায়। ত্রাতুলের জন্য তার মন শুধুই আনচান করে। দুজনেই উত্তরের বাঁশবাগানে ছুটে আসে। সবুজ ঘাস বিছানো জমিতে বসে বাঁশঝারের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক দিয়ে বিশাল আসমানে হালকা মেঘে ঘেরাও করা গোল চাঁদটা দুজনেই অবলোকন করে শুধু। ঠিক যেন চাঁদ আর দুজন মানবের মধ্যে ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক। রুক্ষ হাতের মসৃণ দেহ আদর সূক্ষ্ম সাম্যাবস্থা বজায় রাখে;অশালীনতা পাহারা দেয় চন্দ্রদূত।

কিন্তু চন্দ্রদূত বেশিদিন পাহাড়া দিতে পারলোনা। সামনের বৈশাখে চন্দ্রিমার বিয়ে। দুজনের একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়;অস্পৃশ্যতার বাঁধনে বাঁধা তারা। চন্দ্রিমার মত ত্রাতুলের জীবনেও বৈশাখের ঝড় চলছে। চন্দ্রিমা ঘরে বন্দি। তিনটে চন্দ্রমাস পেরিয়ে গেলো,অথচ দুজনের দেখা নেই। ত্রাতুলের জন্য সে এখন অস্পর্সী।

চন্দ্রের ১৭তম রাত। জানালার গরাদ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ও। জোছনার ঢলের মত চন্দ্রিমার চোখ দিয়ে ঢল নেমেছে। মনে পড়ছে অতীত।

-আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো তো?

মুচকি হেসে ত্রাতুল বলেছিল,
-চুরাশি লক্ষ হাজার বার জন্মাবো,প্রতিবারই জোড়া বেঁধে থাকবো।

-হুঁম,মরণের ওপারেও একসাথেই থাকবো।

একথা বলে খিলখিল করে হেসে দিয়েছিল ওরা। 

বিরহে চন্দ্রিমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে। ত্রাতুলকে ছাড়া তার টিকে থাকা অসম্ভব। কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের প্রান্তে থাকা মজিদের গানের গলা। প্রচন্ড কষ্টে খাটের নিচে রাখা সাদা দড়িটা দেখে মুচকি হাসি হাসলো চন্দ্রিমা। ধীরে ধীরে দড়িটা ছাদ থেকে ঝুলিয়ে নিপুণ একটা ফাঁস তৈরি করলো সে।
.
.
.
তিনটে বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সাথে সাথে ত্রাতুলের পাগলামিও বেড়ে চলেছে। প্রথম দিকে ভালবাসার কান্না কাঁদলেও যে চন্দ্রিমাকে সে এত ভালবাসতো;আজ তারই নাম আর তার মৃত্যুর কথা শুনলে বরং সে খুশিতে হাসে আর পাগলের মত আচরণ শুরু করে। চন্দ্রিমা নাকি মরেনি। এখন নাকি সে প্রতিরাতেই তার ঘরে এসে বলে 'নিঁম,নিঁম'।

প্রচুর কবিরাজ বৈদ্য দেখানো হয়েছে। লাভ হয়নি। বরং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। দূর গায়ের এক ওঝা বলেছিল,'নিঁম' মানে 'নিয়ে যাব'। অর্থ জানতে পেরে খুশিতে নেচেছিল সেদিন ত্রাতুল। পাগলামীর কারণ হিসেবে ওঝা বলেছিল,ত্রাতুলের গায়ে খারাপ বাতাস লেগেছে। ওর কলিজা নাকি পুরোটাই কোনো খারাপ বাতাসে খেয়ে ফেলেছে। 

সময় বেশি নেই। একথা শুনে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়েছিলো ত্রাতুল।
.
.
.
চন্দ্রের ১৭তারিখ। 

বাইরে জ্যোছনার ঢল নেমেছে। 

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ত্রাতুল। আসমানের দিকে একবার তাকিয়ে উত্তরের বাঁশবাগানে ওদের সেই প্রেমস্থানে এলো ও। তবে আজ গন্তব্য আরো সামনে। উত্তরের জংলা নির্বিকারে পেরিয়ে এলো। জংলার ওপারে শ্মশানে এসে থামলো ও। শ্মশানে কোনো জাতের প্রভেদ নেই। সবারই মিলনস্থল। মড়া পোড়ানোর ঢিবির উপর চন্দ্রিমা বসে আছে। দুজনেই দুজনকে দেখে হাসলো।

চন্দ্রিমা বললো,
-আজ তোমায় নিতে এসেছি। তোমায় মরণের ওপারে নিয়ে যাবো।

-কিন্তু কিভাবে যাবো তোমার সাথে?

চন্দ্রিমা মুচকি হেসে আঙ্গুল দিয়ে ত্রাতুলকে বটগাছটা ইঙ্গিত করলো।
বটগাছের দিকে তাকালো ত্রাতুল। ফাঁসির দড়িতে চন্দ্রিমা ঝুলছে। খুলে থাকা চোখ দুটো প্রচন্ড যন্ত্রণায় ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। থুতনি পর্যন্ত জিহ্বাটা বেড়িয়ে এসেছে। তাতে দুই কপাটির দাঁতেরই তীব্র কামড় বসে আছে। বটগাছের ডাল থেকে ফাঁসির দড়িতে চন্দ্রিমার দেহটা মৃদু বাতাসে মৃদু দুলছে। 

পিছনে মড়া পোড়ানোর ঢিবিটার দিকে তাকালো ত্রাতুল। চন্দ্রিমা বসে আছে,আর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ত্রাতুলও একচিলতে হাসি দিয়ে সামনে তাকালো। বটগাছের ডালে সাদা একটা দড়ি ঝুলছে।
.
.
.
ত্রাতুল ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে চাঁদটা। ক্রমশ অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসার সাথে সাথে গ্রামের প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মজিদের করুণ গলার সুর-
                                        'ভালবাসার মান জানিনা,
                                            জোড়া বেঁধে রই;
                                        নিঠুর তোর পথে আসছি,
                                            সখীরে তুই কই?'

No comments:

Post a Comment