এ শহরে প্রতিটি ইটের কোণায় লুকিয়ে থাকে গল্প। গল্পরা হাঁটতে জানে না,জানলে আন্দোলন করতো। ওরা আবার ভীষণ অভিমানী..!!
মরইণ্যা
- অ মইনুদ্দী,হুনছোত নি? খোকন চোরায় ত পা ভাঙছে..
- কি কও? ক্যামনে?
খানিকক্ষণ হো হো করে হেসে দম ফেললেন মকবুল মিয়া। ফিক ফিক করে হাসতে হাসতেই বললেন,
- আর ক্যামনে? ইউসুপের কব্বরের ধারে যেই খেজুর গাছ আছিলো,হেইডাত রস চুরি করতে উঠছিলো মাইজ রাইতে। রস নামানের সময় কব্বর থেইকা ইউসুপ কয়,ক্যাডায়,ক্যাডায় গাছে? আর যায় কই..!! ডর খাইয়া খোকইন্যা ধিড়িম কইরা নিচে পড়ছে।
আবারো তারস্বরে হো হো করে হেসে উঠলেন মকবুল মিয়া। সাথে মইনুদ্দীর ফোকলা দাঁতও বেরিয়ে পড়লো। দু'জন একসাথে হেসেই চলেছেন। দোকানদার রামলাল যারপরনাই বিরক্ত। কবর থেকে ইউসুফ ব্যাপারী কথা বলেছেন,সেই ভয়ে একটা মানুষের পা ভেঙ্গেছে,এতে হাসার কি আছে?
.
.
.
ইউসুফ ব্যাপারী,ধলপুরের প্রতাপশালী ব্যক্তি। প্রতাপের জোরে জায়গা দখল,লুট-পাট এমনকি খুন-খারাবি কোনো কিছুই বাদ যায়নি।
একদিন সন্ধ্যায় গাঙের ঘাট থেকে স্নান শেষে ফিরছিলো হরিমতি। ইউসুফ ব্যাপারী লোভী চোখে পথ আগলে দাঁড়ায় হরিমতির। গা বাঁচাতে সে পথের ধারে রাখা ইট টা ঠুকে দেয় ব্যাপারীর কপালে।
থানা থেকে দারোগা এসে ধরে নিয়ে গেলো হরিমতিকে। রায় যাবজ্জীবন। গ্রামের মানুষ হরিমতির পক্ষই নিয়েছিলো। ফাঁসি টা সেই সুবাদে এড়ানো গিয়েছিলো। ওদিকে ব্যাপারীর জানাযা পড়াবার মতও কেউ ছিলো না। ইমাম সাহেব আর খাদেমরা মিলে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করলেন,ব্যাপারীর বাগান-বাড়িতে।
ক'দিন পর থেকে ঘটনা শুরু। গ্রামের লোকজন বাগান-বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাতায়াতই ছেড়ে দিলো। ব্যাপারী নাকি তার কবরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে,নাচানাচি করে এমনকি কেউ কেউ কবরের উপর বসে বিড়িও ফুঁকতে দেখেছে তাকে।
"পাপী মাইনষের কব্বর,সবই আযাবের নমুনা।" রহিমা বেগমের নাতনীর কথার বেড়ে ফের প্রশ্ন,
- কব্বরের উপ্রে বইয়া বিড়ি খাওন আবার কেমন আযাব গো,দাদী?
- চুপ করতো ছেমড়ি,মাইয়া মাইনষের এত্তো জাইন্যা কাম কি?
.
.
.
মকবুল মিয়া পান চিবোতে চিবোতে চায়ের কাপ টা মুখে তুললেন।
- ধুরো লামলাল,তোমার খাছালতটাই গ্যালো না। আজকেও লিকার কম,চায়ের ত কোনো স্বাদই নাই।
- আগে পান চাবানি বন্ধ করেন। পান চাবানের সময় চা খাইলে চায়ের স্বাদ আবার পাইবেন কই?
মকবুল মিয়া আর কোনো কথা বললেন না। মইনুদ্দীর দিকে মুখ ফেরালেন।
- অ মইনুদ্দী,হুনছোত নি ঘটনা? ইউসুপের কব্বরে ত ফের আযাব ফিরছে।
- কি কও মিয়াসাব..!! ঘটনা কি?
- আর কইছ না,কাইলকা বিয়ানবেলা নাকি করিইম্যার ছোডো পোলায় আইতাছিলো বাগানবাড়ি দিয়া। দূর থেইক্যা দেহে ধোঁয়া উঠতাছে সামনে। কাছে ভিড়া দেহে,ইউসুপের কব্বরের গর্ত থেইক্যা ধোঁয়া উঠতাছে। পোলায় ত ঝাইড়া দৌঁড়,ঘরের সামনে পৌঁছাইয়াই ফিট খাই গেলো।
- আ রি মিয়াসাব,দশবছর পরে নি আবার আযাব শুরু হইলো?
- পাপের কি আর বয়স আছে রে? পাপীর পাপ,আছমার বাপ..!!
.
.
.
গফুর মোল্লা বেশ কয়েক বছর ধরেই এ পথে যাতায়াত করেন। ভূত-টূতে ভয় নেই তার। আজ পর্যন্ত ইউসুফ ব্যাপারীর কানাঘুষোর টিকিটাও দেখতে পান নি। তবে আজ কেনো জানি ভয় করছে। কবরের মাথার দিকে গর্তটা বেশ বড় হয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়,কে যেন ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কবরের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়ালেন গফুর মোল্লা। কবরের মাথার দিকে যে গর্তটা,তার পাশেই আগুন জ্বলছে। লাল,ছোট্ট একটা আগুনের কুন্ডলী লাফাচ্ছে যেন।
এ-ই তাহলে সেই,ব্যাপারীর খারাপ আত্মা। ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করলেন গফুর মোল্লা। খানিক বাদেই ঝেড়ে দৌঁড়।
.
.
.
- মইনুদ্দী রে,পাগলডারে দেখতাছি না মাসখানেক হইলো,গ্যাছে কই?
- কার কথা কন? মরইণ্যা?
- গেরামে পাগল আর আছে ডা ক্যাডায়,শুনি?
মকবুল মিয়ার এমন কথায় রামলাল মনে মনে বললো,"বুইড়া,তুমি কি সুস্থ আদমি নাকি? পান চিবানের সময় চা খাও,আবার চায়ের স্বাদও চাও।"
মইনুদ্দী শুধরালো,
- পাগল ছাগল মানুষ। কই যায়,কই থাকে,ক্যাডায় জানে..!! রামলালের ত আবার বিশাল ক্ষতি।
কথাটি বলেই হো হো করে হেসে উঠলো সে।
মরইণ্যা বাসা-বাড়ি থেকে খাবার ভিক্ষে করলেও দিনে দশটা বিড়ি নগদে রামলালের দোকান থেকে কিনতো।
রামলাল গম্ভীর স্বরে বললো,
- দোকান আমার মরইণ্যার বিড়ির নামে না,ভগবানের নামে চলে। ভগবানের কাছে ট্যাকাই মাটি,মাটিই ট্যাকা।
.
.
.
বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে,ইউসুফ ব্যাপারীর বাগান-বাড়ির সমস্যা চরমে উঠেছে। নিতান্ত বাধ্য না হলে পারতপক্ষে কেউ ওপথ মাড়ায়-ই না।
মকবুল মিয়ার আবার গল্পের খুব শখ। আজ ঠিক করেছেন ও-পথ দিয়ে বাসায় ফিরবেন। একবার পেরোতে পারলে বাজারে বেশ ঘটা করে বলতে পারবেন,ব্যাপারীর আত্মা তাকে ভয় দেখায়না,নিজেই ভয় পায়।
কবরের পাশ দিয়ে যেতেই গর্তটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। মনে হচ্ছে,কেউ যেন ভেতর থেকে তাকে দেখছে। মন প্রচন্ড বারণ করলেও একটু সাহস করে,হাঁটু গেড়ে,মাটিতে উপুর হয়ে যেই উঁকি দিবেন,অমনি কালো শীর্ণ একটা হাত খপ করে মকবুল মিয়ার হাত চেপে ধরলো।
"ও মা-গো..!!"- বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে রটে গেলো,"ব্যাপারী,মকবুল মিয়ার হাত চাইপা ধরছে।"
.
.
.
সপ্তাহখানেক জ্বর-ভোগের পর সুস্থ হয়ে আজ রাত্তিরের পান খেতে বাজারে এসেছেন মকবুল মিয়া। মইনুদ্দী পাশে নেই। একা একা রামলালের সাথে গপ-সপ করতে ভালো লাগেনা তার। রামলাল সচরাচর কথাও বলেনা তেমন।
পান চিবোনের মাঝসময়ে মইনুদ্দী হঠাৎ কোথা থেকে যেন দৌঁড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো।
- কি রে মইনুদ্দী,দৌঁড়াস ক্যান? কি হইছে?
মইনুদ্দী হাঁপাতে হাঁপাতেই উত্তর দিলো,
- মিয়াসাব,আইতাছিলাম বাগানবাড়ি দিয়া। দেহি ব্যাপারী কব্বরের উপর উইঠ্যা বিড়ি টানতাছে। আমারে কয়,ওই মইনুদ্দী,আয় বিড়ি খাইয়া যা।
- হয়তো ভুল দেখছোত।
- আরে না মিয়া,এহনও বিড়ি টানতাছে। বিশ্বাস না হইলে চলো আমার লগে?
"কি কস..!!"- বলেই মকবুল মিয়া ছুট লাগালেন। ইতোমধ্যে জনা-বিশেক লোকও জমে গেছে। তারাও পিছন পিছন ছুট লাগালো।
.
.
.
দৌঁড়োনোর সময় দূর থেকেই মকবুল মিয়া অন্ধকারে দেখতে পেলেন,একটা অবয়ব যেন কবরের উপর বসে বিড়ি ফুঁকছে। কাছে পৌঁছানোর পর দেখতে পেলেন,অবয়বটি তখনও কবরের উপর বসে বসে দিব্যি বিড়ি ফুঁকছে। ততক্ষণে বাদবাকি সবাই এসে পড়েছে।
মকবুল মিয়া ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবয়বটির উপর টর্চ ফেলতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
- কি রে মরইণ্যা? তুই এইহানে? গত দেড়মাস কই ছিলি?
মরইণ্যা এক হাসিতে সবগুলো হলুদ দাঁত বের করে উত্তর দিলো,
- ক্যান? যেইখানে বইসা আছি,এইখানেই ত ছিলাম..!!
আসছে....
(১)
নীলাদ্রি জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বাতি নেভানো,কিন্তু সবকিছু দিব্যি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো জানালার গরাদ ঠিকরে ভেতরে ঢুকে পড়ছে। নীলাদ্রি খুব নিচু স্বরে গান গাইছে।
চাঁদের আলো কালো ঘরে,
ঢুইকা আমায় কয়-
কালো ঘরে কালো তনু,
প্রাণে কি আর সয়?
কোথাও হয়তো রাতজাগা এক পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠলো। একঝাঁক বাদুড় নিঃশব্দে জ্যোৎস্নায় ছায়া ফেলে উড়ে যাচ্ছে। নীলাদ্রি গান থামিয়ে ফেললো হঠাৎ। তার কান্না পাচ্ছে। হাসনাহেনার তীব্র ঘন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
তার মন আজ খুব খারাপ। কি কারণে খারাপ,সে জানেনা। বেশিরভাগ সময়ই অকারণে মন খারাপ হয়। নীলাদ্রি জানে,পৃথিবীর কোনো কিছুই কারণ ছাড়া হয় না। অকারণে মন খারাপের পেছনেও একটা কারণ থাকে। বেশিরভাগ সময়ই সেটা কেউ বুঝতে পারেনা,কিংবা বুঝতে পারলেও মনে করতে বা বলতে চায় না।
নীলাদ্রির ঘোর হঠাৎ কেটে গেলো। ডাইনিং রুমে চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাবা'র গলা। নীলাদ্রি জানালার কাছ থেকে সরে এলো। বাবাকে থামাতে হবে। নাহলে প্রেশার উঠিয়ে ডাক্তার-হাসপাতাল বাঁধাবে।
(২)
আকবর সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। বেশ কায়দা করে তাকে শান্ত করতে হয় নীলাদ্রির। এর আগে,রাগের কারণে চিৎকার করতে গিয়েই স্ট্রোক-টা করেছিলেন। স্ট্রোকের পর থেকে নীলাদ্রি বহু বুঝিয়ে-শুনিয়ে তবেই বাবার মাথা ঠান্ডা করে। মেয়ে ছাড়া অন্য কেউ ঠান্ডা করতে এলে এক চড়ে উল্টো তাকেই ঠান্ডা করে দেন আকবর সাহেব। এমনকি সে হোসনেআরা বেগম হলেও।
- এবার বলো বাবা,চেঁচাচ্ছিলে কেনো?
- এমনিই। তুই যা মা,ঘুমো গিয়ে।
- ঠিকাছে বাবা,আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। তুমিও শুয়ে পড়ো। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আর চেঁচামেচি করোনা। শরীর খারাপ হবে।
- ঠিকাছে রে মা,তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো গিয়ে।
নীলাদ্রি উঠে চলে গেলো। আকবর সাহেব ক্লান্তকর একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ কিসের জন্য এতো চেঁচামেচি,জানার জন্য দ্বিতীয়বার আগ্রহই প্রকাশ করলো না মেয়েটা। কোনো কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই তার। সবসময় কৌতুহল থেকে বিরত রাখে নিজেকে। এভাবে চলতে থাকলে তো একসময় জগৎ-সংসারের উপর থেকে মায়া উঠে যাবে মেয়েটার।
হোসনেআরা বেগমের মুখ থমথম করছে। খানিকটা ভীত গলায় আকবর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এখন কি করবে? দাড়োয়ানের মাথা তো মনে হয় খারাপ হয়ে গেছে।
- খারাপ হয়েছে মানে? হারামজাদা খাসা পাগল হয়ে গেছে। সকাল হলেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেবো।
- বের করে দিলে তো রাস্তায় রাস্তায়ই ন্যাংটো হয়ে ঘুরবে।
আকবর সাহেব এবার হোসনেআরা বেগমের দিকে কটমটিয়ে চাইলেন।
- তো কি করবো? বদমাশটাকে ঘরে এনে সাজিয়ে রাখবো?
- ভালো দেখে কোনো একটা মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও?
- আমার অত ঠ্যাকা নেই। বের করে দেবো। যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে গিয়ে ন্যাংটো হয়ে বসে থাকুক।
(৩)
সকাল আটটা বেজে গিয়েছে। নীলাদ্রি তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলো। ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে আর আধঘন্টা পরেই।
দরজা দিয়ে বেরোবার সময়ই লম্বা এক স্যালুট ঠুকলো ইসমাইল। সবগুলো দাঁত বের করে,বিশাল হাঁ করা এক হাসি দিয়ে ডগমগে গলায় বলে উঠলো,
- কাল রাইতে স্যার যা কইছে,সত্যি ছিলো আপা। কিন্তু আমার তাতে দোষ নাই। কি করমু আপা,কন? যা গরম পড়ছে,গতরে কাপড় রাখাই দায়..!!
নীলাদ্রি বলে উঠলো,
- মানে? বুঝলাম না।
- থাক আফা,বুঝন লাগতোনা। যেইখানে যাইতাছিলেন,যান।
(৪)
ম্যানেজার মাইনুর কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন ইলিয়াস সাহেবের সামনে। ইলিয়াস সাহেবের মাথায় আইসব্যাগ ধরে রাখা হয়েছে।
ইলিয়াস সাহেবের অফিসে পোষা একটা ময়না ছিলো। কটকট করে কথা বলতে পারতো। কোনো একটা শব্দ দু'তিন দিন ক্রমাগত শুনতে থাকলে অতি দ্রুত সে শব্দ লুফে নিতে পারে ময়না পাখিরা।
ইলিয়াস সাহেব সারাক্ষণই অফিসে 'মাইনুর-মাইনুর' করতেন। পাখিটাও কেনার এক সপ্তাহের মাথায় কথা বলতে শুরু করে। ম্যানেজার মাইনুর রুমে ঢুকলেই ময়না বলে উঠতো,
- মাইনুর তোর নাম কি? মাইনুর তোর নাম কি?
জবাব না দিলে চিৎকার ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকতো।
ইলিয়াস সাহেব ইদানীং অফিসে যাচ্ছেন না। ছোট ছেলের জন্য বিয়ের পাত্রী দেখছেন। মহাযজ্ঞীয় ব্যাপার..!! ম্যানেজারও এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ময়না পাখিটাকে দিয়ে গিয়েছিলেন অফিসের ড্রাইভার-গার্ডদের মেসে'তে। ফিরে এসে ময়না পাখিকে দেখেই চক্ষু চড়কগাছ..!! এ ময়না আর আগের ময়না নেই। যে'ই সামনে আসছে,ময়নার মুখে একটাই কথা,
- নটির পুত তোর নাম কি? নটির পুত তোর নাম কি?
সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হচ্ছে,পাখিটা ইলিয়াস সাহেবকে দেখার পর থেকে অনবরত এ কথা বলেই যাচ্ছে। ম্যানেজার মাইনুর সারা দিন-রাত চেষ্টা করেও পাখির মুখে অন্য কোনো বুলি ফোটাতে পারছেন না।
(৫)
ইলিয়াস সাহেব বাসায় ঢুকেই রাহেলা বেগমকে ডাকলেন।
- হারামজাদা কি এখনও ঘুমোচ্ছে?
- না,নাস্তা করে বেরিয়েছে।
- তা তো বেরোবেই। অকর্মাদের তো একটাই কাজ,ধ্যাই ধ্যাই করে ঘোরা। তা তোমার বড় পুত্তুর কোথায়? সেও কি ঘুরে বেড়াচ্ছে?
- সে কি? ও না তোমার সাথে অফিসে গেলো?
- হবে বোধহয়,ভুলে গেছি। এক কাপ চা আনো।
(৬)
ইলিয়াস সাহেবের বড় ছেলে যায়েদ। একমনে ফাইলপত্র সই করে চলেছে। সামনের চেয়ারে যে সায়েদ বসে আছে,ভ্রূক্ষেপই নেই।
- এ্যাই দাদা,পালিয়ে যে বিয়ে করেছিলি,ফিলিংস কেমন ছিলো রে?
- হুঁ? কিছু বললি?
- বললাম যে,পালিয়ে বিয়ে করতে অনুভূতি কেমন?
যায়েদ ফাইলপত্র থেকে মুখ তুললো,মুখটা হাসিতে ভরে উঠেছে।
- সত্যি বলবো?
- আমি কি মিথ্যাটা জানতে চেয়েছি?
- অসাধারণ অনুভূতি,পুরো এ্যাডভেন্ঞ্চার..!!
- আর বাসায় ফেরার পর বউয়ের সামনে যে বাবার হাতে থাপ্পড়,সেটা?
যায়েদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার ফাইলে মুখ গুঁজলো।
- তুই আমার রুম থেকে বেরো।
- কেনো? সমস্যা কি?
- বের হতে বলেছি,বেরো। নাহলে ম্যানেজারকে ডেকে বের করে দেবো।
- কাউকে বের করতে হলে গার্ডকে ডাকতে হয়। ম্যানেজারকে নয়।
- তুই যাবি?
- ঠিকাছে,যাচ্ছি তো।
দরজার সামনে গিয়ে সায়েদ আবার ঘুরে দাঁড়ালো।
- আমারও পালিয়ে বিয়ে করার শখ ছিলো। কিন্তু বাবার চড়ের ভয়ে শখ টা আর মিটলোনা।
(৭)
সায়েদ বড় ভাইয়ের রুম থেকে ম্যানেজার মাইনুরের রুমে ঢুকলেন। ম্যানেজার তখনও ময়না কে বুলি পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। সায়েদকে দেখে ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
- কেমন আছেন মাইনুর সাহেব?
- জ্বী ভাইজান,ভালো।
- আপনি আমার বড় ভাইকে স্যার বলে ডাকেন,আমাকে ভাইজান ডাকেন কেনো?
ম্যানেজার অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
- না মানে,আপনি তো অফিসে বসেন না,তাই আর কি..
- শোনেন ম্যানেজার সাহেব,গরুর পুত্র গরুই হয়,বসের পুত্র বস ই হয়।
- জ্বী ভাইজান,আজ থেকে স্যার বলে ডাকবো।
- প্রয়োজন নেই,ভাইজান ই ডাকবেন। গরুর উপমা আমার জন্য প্রযোজ্য না।
- জ্বী ভাইজান,তা তো অবশ্যই।
সায়েদ কতক্ষণ ময়না পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঘুরে চলে যাবে এমনসময় বলে উঠলো,
- আচ্ছা মাইনুর সাহেব,ময়না পাখির মাংস কি খাওয়া যায়?
- জানি না ভাইজান। কেনো?
- খাওয়া গেলে এটাকে রোস্ট বানিয়ে খেয়ে ফেলুন। মিনিটে তো বোধহয় শ'খানেক গালি দিচ্ছে..
(৮)
নীলাদ্রির মন আজ একটু বেশিই খারাপ। পূর্ণিমার শেষ কয়দিনে যখন আলোর ভাটা পড়তে শুরু করে,তখন ও ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। অন্ধকার যেন ওর গায়ের রং-কে আরো গাঢ় করে তোলে। হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গন্ধটা যেন প্রভাবকের কাজ করছে। নাক দিয়ে বুকের ভেতরে ঢুকে চাপা কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নীলাদ্রির অতি পছন্দের সেই লাইনগুলো এখন বড্ডো মনে পড়ছে। সে মিনমিন করে লাইনগুলো সুরে তোলার চেষ্টা করলো-
ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া-
জ্যোৎস্না ধরতে যাই;
আমার হাত ভর্তি চাঁদের আলো,
ধরতে গেলেই নাই..!!
সুর টা হঠাৎ থেমে গেলো। নীলাদ্রির চোখে কিছু একটার নড়াচড়া ধরা পড়ছে। ওর জানালাটা বাসার পেছনের বাগানমুখী। জায়গাটা জংলামত,ঘাসে ভর্তি,বেশ রকমের গাছও আছে। পরিস্কারের অতি প্রয়োজন না পড়লে সচরাচর কেউ যায় না,এত রাতে তো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া স্ট্রীট ল্যাম্পের আবছা আলোয় সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্তই বাগানে আলো-আঁধারীর খেলা চলে যেন।
নীলাদ্রি জানালা দিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। একজন মানুষের ছায়াকে দেখা যাচ্ছে,মনে হচ্ছে হাঁটছে। দূরে কোথাও রিক্সার ক্রিংক্রিং শব্দ হলো। নীলাদ্রি বিদ্যুৎবেগে জানালা থেকে সরে এলো।
লোকটি অন্ধকার থেকে আবছা আলোতে এসেছে,চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গায়ে কোনো কাপড় নেই..!!
(এখনও ইচ্ছে করেই শিরোনাম দিইনি গল্পটির,হয়তো কোনো একদিন বাকী অংশটুকু লিখে শিরোনাম দেবো। এটুকু পড়ার পর খেপে যাওয়া,পড়তে ইচ্ছুকগন,ইনবক্স কিংবা কমেন্টে গালাগালি করতে পারেন। আমার গল্পের পাঠক আবার খুবই কম। গালাগালির পরিমাণও তাই শূন্য।)
হ্যাংলা দা
- কখনো মড়া পুড়িয়েছিস,নিতাই?
- মড়া? ঢের পুড়িয়েছি। এই গেল হপ্তায় ই তো নিবারণ কাকুর মড়া পোড়ালাম।
সুদেব যেন একটা ধাক্কা খেলো। ভারী একটা অবাক চোখে নিতাইর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কি বলিস? কিভাবে?
- আর বলিস না। অম্বল হয়েছিলো। বেচারা সারাজীবন অন্যকে অম্বলের অষুধ দিয়ে শেষমেষ কিনা নিজেই মরে গেলো,আহারে..!!
- তবে হ্যাংলা দা যে আমায় কিচ্ছুটি বললোনা?
এবার নিতাই যেন একটা ধাক্কা খেলো। ভারী অবাক চোখে সুদেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
- হ্যাংলা দা? কোথায় পেলি তাকে?
- কেনো? সে ই তো আমাকে নদী পার করে দিলো। হ্যাংলা দা না থাকলে এই শীতের রাত্তিরে নৌকো যে কোথায় পেতাম,ভেবেই দায়।
নিতাই যেন কথাটা বিশ্বাস করলো না। ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- তুই সত্যি বলছিস তো সুদেব?
- ভারী আজিব..!! মিথ্যে বলতে যাবো কোন সঙে? হ্যাংলা দা এর মত ভালো ছেলে এই তল্লাটে দ্বিতীয়টা আছে নাকি যে মিথ্যে বলতে যাবো?
নিতাই হাত বাড়িয়ে বললো,
- তবে আমায় ছুঁয়ে বল?
সুদেব একটু বিরক্তির সাথে নিতাইর হাত ছুঁয়ে বললো,
- হারামজাদা,এই নে,তোর হাত ছুঁয়েই বলছি।
নিতাই হাঁটার মাঝেই থমকে দাঁড়ালো।
- কি রে,থামলি কেনো? কত দূর পথ বাকি। ভাগ্যিস মাঝপথে তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। নইলে এই নিশি রাত্তিরে একা একা পথ যেতে ভীষণ বাজে লাগতো। যদিও হ্যাংলা দা কে বলেছিলাম,বাড়ি পর্যন্ত আমার সাথেই যেতে। বললো,তার নাকি বাজারে কি সব কাজ আছে।
নিতাই শান্ত স্বরে বললো,
- সুদেব,চুপ কর। হ্যাংলা দা দিন পনেরো আগে মারা গেছে।
সুদেব খানিকক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে উঠলো।
- ঢপ মারছিস হারামজাদা..!! হ্যাংলা দা মরে গেলে আমায় নদী পার করে দিলো কে? তোর শ্বশুরমশাই?
- আমি কিন্তু সত্যি বলছি সুদেব।
- ধুর,ঢপ মারছিস। আচ্ছা,গা ছুঁয়ে বল দেখি?
নিতাই সুদেবের গা ছুঁয়ে বললো,
- সত্যি বলছি। গত মাসের শেষের দিকে ট্রেনে কাটা পড়ে মরে গেলো। আমি নিজে কালীঘাটের চিতায় উঠিয়েছি।
সুদেবের মাথাটা ঝিঁ ঝিঁ করছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো দরকার।
.
.
.
সুদেব শুয়ে আছে। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বোধহয় জ্বর আসছে। ভয়ে নাকি নদীর ঠান্ডা হাওয়ায়,ধরা যাচ্ছেনা। তবে ঠান্ডা হাওয়ার জন্যই হবার সম্ভাবনা বেশি। হ্যাংলা দা'র ঘটনা জানার পর বিষম খেলেও ততটা ভয় পায়নি। ছোটবেলা থেকেই সুদেব কিছুটা সাহসী।
ঠাকুর'দা একবার বলেছিলেন,"সুদেব নামটাই পূণ্য। নামের মধ্যে একটা দেবতা দেবতা ভাব আছে। আমার নাতিকে কোনো শয়তান ভয় দেখাতে আসলে মুন্ডি কেটে রেখে দেবে।"
যদিও সুদেব বয়স পাঁচেক সময় হিজলতলায় হামা ভূতের চড় খেয়েছিলো। চড় খাওয়ার পরপরই হিজলতলার সব গাছ কেটে ফেলা হলো। বাবু বংশের ছেলের গালে চড়? ভূতদের গুষ্টিই উঠিয়ে দেবো ক্ষণ..!!
সুদেব অনেক চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছেনা। শুয়ে শুয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগলো শুধু। ডানদিকে চোখ পড়তেই চোখ কুঁচকিয়ে ফেললো। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। আবছা আলোতে বেশখানেক সময় তাকিয়ে থাকার পর বুঝলো,কে যেনো পড়ার টেবিলের চেয়ারটা ঘরের মাঝে এনে তাতে বসে আছে।
অবয়বটা উঠে দাঁড়ালো। হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোতে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে,একটা ছেলে। ছ'ফুটখানেক লম্বা,টিঙটিঙে শরীর,অন্ধকারের কালো রংয়ের মাঝে অবয়বটা আরও গাঢ় কালো হয়ে আছে। কালো শরীরে ধূসর রংয়ের ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ভারী ঢিলেঢালা একটা গেন্জি পরনে।
অবয়বটা ঠায় চেয়ার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে। সুদেব বিছানায় উঠে বসতে বসতে যেন অবয়বটাকে খানিকটা চিনতে পারলো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,"হ্যাংলা দা?"
বলতে বলতেই ধপ করে ফের বিছানায় পড়ে গেলো সে।
.
.
.
নিতাই খেতে খেতে ছ্যাঁক করে উঠলো।
- দেখ দেখ সুদেব,পড়লো তো পড়লো,আমার মুখেই পিত্তি টা পড়লো..!!
সুদেব চুপচাপ খেয়ে চলেছে। গায়ের জ্বর ভীষণ বেড়েছে। মা বলেছিলো,ঘর থেকে বেরোতে না। কিন্তু সুদেবেরও আবার ঘরে মন টেকে না। পাছে নিতাই,ভাজা ইলিশের নেমন্তন দিলো।
- বুঝলি সুদেব,মাছের পিত্তি মুখে পড়লেই মুখটা বেস্বাদ হয়ে যায় রে। মানুষের পিন্ডিরও একই কাহিনী। সেদিন কি হয়েছিলো জানিস? হ্যাংলা দা'র মড়া পোড়াচ্ছি,হঠাৎ করে কি যেন 'টাস্' করে উঠলো। দেখি আমার মুখে ছিটছিটে পোড়া মাংসের টুকরো। আমি তো যা ভয় পেলাম..!! অম্বিকা কাকু বললো,ভয় পাসনে,ওটা পিন্ডি ফেটেছে।
নিতাই হো হো করে হাসছে। সুদেব খাওয়া বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। হাত ধুতে কলপাড়ে যেতে হবে। শরীরটা বেজায় ভার লাগছে।
কল চেপে হাত ধুতে ধুতে যেই-ই সুদেব ঘাড় উঠিয়েছে,দেখে হ্যাংলা দা দাঁড়িয়ে। ছ'ফুটখানেক লম্বা,টিঙটিঙে শরীর,মিশকালো গায়ের রং। কালো শরীরে ধূসর রংয়ের ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ভারী ঢিলেঢালা একটা গেন্জি পরনে।
সুদেবের চোখের পলক পড়ছেনা,বোধহয় দৃষ্টিভ্রম। হ্যাংলা দা বলে উঠলো,
- জানিস রে সুদিব? ঝুড়িবোঝাই করে ইলিশ মাছ নিয়ে যাচ্চিলাম বাজারে,হঠাত করি রেলে পা আটকে গেলো। কত তড়পালাম,ছাড়লোই না..!! পিছ ফিরতেই দেখি ট্রেনমামা ঘটঘট করি চলে গেলো উপর দিয়ে।
সুদেবের গা শিরশির করে উঠলো। হ্যাংলা দা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সুদেব চোখ ডললো। দৃষ্টিভ্রম গেলো না। হ্যাংলা দা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জ্বর বোধহয় বেশ বেড়েছে। চোখের ধাঁধা তাই গেড়ে বসেছে।
সুদেব উঠে দাঁড়ালো পেছন ঘুরে। বাড়ি গিয়ে একটা কষে ঘুম দিতে হবে। পেছন থেকে হ্যাংলা দা যেন বলে উঠলো,
- আমি ইলিশ মাছ নিয়ে ট্রেনে কাটা পড়লাম,আর তুই আমায় দেখে সেই ইলিশ খেতে পারলি না। সুদিব রে,ইলিশ আর খাস নে। তুই না আমায় কত ভালো পেতি?
.
.
.
নিতাই সুদেবকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
- এত কষ্ট করে বৌদিকে দিয়ে তোর জন্য মাছ ভাজালাম,তুই তো একটাও খেতে পারলি না। জ্বর কি খুব বেশি?
সুদেব গোঁ করে উঠলো,
- হুম।
- আচ্ছা সুদেব,বলতো দেখি,ইলিশ মাছের গায়ের রং এমনতর হয় কেন?
সুদেব বললো,জানিনা।
নিতাই কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
- কাউকে বলিস না। হ্যাংলা দা বলেছিলো। আমরা দশমীতে যেই দুর্গাকে ভাসিয়ে দিই,অমনি ইলিশেরা সেইদিন ঝাঁক বেঁধে মায়ের মাটি খায়,অলংকার খায়। তাই নাকি ইলিশের রং এত খোলতা হয়..!!
সুদেবের মাথায় কিছু ঢুকছেনা। হাজার হাজার মাছি যেন মাথার ভেতর ভনভন করে ঘুরছে।
.
.
.
ঘুম ভাঙতেই সুদেব উঠে বসলো। শরীরটা এখন একটু হালকা লাগছে। তিন বছর পর বাড়ি এসে নিজের ঘরটাকেও ভালমত দেখা হয় নি। মা এসে চালভাজা দিয়ে গেলো।
- বাপধন,যা জ্বর বাঁধিয়েচিস..!! চালভাজায় পেঁয়াজ মরিচ দিয়েচি। চাবা বসে বসে,স্বাদ জুটবে।
সুদেব মাথা নেড়ে চালভাজার দিকে হাত বাড়াতেই দেখে,সামনে বসে হ্যাংলা দা দিব্যি চালভাজা চিবোচ্ছে।
- বুঝলি রে সুদিব,মরে যাওয়ার পর কিচ্ছুটি খেতে পারি নে। সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। এই দেখ,তোর মনে হচ্ছে চাল চিবোচ্ছি,আসলে কিন্তু চিবোচ্ছি না। হো হো..
সুদেবের ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দেয়। কিন্তু তা করা সম্ভব হচ্ছে না কেন যেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
- তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেনো,হ্যাংলা দা?
- সে কি রে..!! তুই না আমার জাতভাই? তোর কাছে আসবো না তো কি নিতাইর কাছে যাবো?
- তুমি না মরে গেছো? দুনিয়াতে থেকে আর কাজ কি?
- স্বাদে কি আর থাকি রে? নিবারণ কাকু মরলো,তিনকূলে কেউ ছিলো না। কবিরাজ বলে সায়েবের লোকেরা মস্ত বড় ভুজ্যি দিলো। সায়েবের ছেলে মুখাগ্নি দিলো। বলি আমার থেকেই তো সব ইলিশ নিতি,দামও দিতি না ঠিক করে। আমারও তো তিনকূলে কেউ নেই। ওরা কি পারতো না আমার নামে একটা ভুজ্যি দিতে? গাঁয়ের লোকের কম উপকার করেছি আমি? ঘর পাহাড়া,খেত নিড়ানো,গরু ধরে দেয়া,কম কাজ করেছি? শালা শুয়োরের দল।
সুদেব ঘোঁৎ করে উঠলো।
- ভুজ্যি না দিলে স্বর্গে যাওয়া যায় না বুঝি?
- সে তো জানি নে। তবে আমায় যে যেতে দিচ্ছে না।
সুদেবের মনে হচ্ছে,তার মাথাটা গেছে। নাহলে চোখের সামনে মরে যাওয়া মানুষ জমিয়ে আড্ডা দেয় কিভাবে..!!
.
.
.
দিন চারেক পেরিয়ে গেলো। সুদেব উঠতে বসতে হ্যাংলা দা কে দেখতে পায়। হয়তো মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে চোখ মেলে তাকিয়েছে,দেখা গেলো হ্যাংলা দা মশারির উপর শুয়ে আছে নয়তো কড়িকাঠ ধরে ঝুলে আছে। ভোরবেলা কলপাড়ে গিয়ে দেখা গেলো,সে আগে থেকেই কয়লা তুলে দাঁত মাজছে।
- ভূতদের আবার দাঁত মাজা লাগে নাকি,হ্যাংলা দা?
- শখের বশে মাজি আর কি। দেখতো,এই দাঁতটা পরিষ্কার হয়েছে কি না?
এই বলে হাত দিয়ে একটা দাঁত খুলে সুদেবের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
সুদেব বুঝতে পারছে না কি করবে। হ্যাংলা দা পিছু ছাড়ছে না। মরে যাওয়া মানুষ পিছু পিছু ঘুরলে নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। হাজার হলেও সুদেব শহরে থাকে,বাস্তবতা আছে একটা।
.
.
.
সেদিন মাঠে বসে সুদেব প্রক্ষালন সারছে,পাশে তাকিয়ে দেখে হ্যাংলা দা-ও সেভাবেই বসে আছে। সুদেব ফিক করে হেসে বললো,
- ভুতরা শুধু খেতে পারে জানতাম,হাগতেও পারে,জানতাম না তো হ্যাংলা দা।
হ্যাংলা দা নদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
- সুদিব,ভুতরা সব পারে। আর আমি তো সেই ধরনের ভুত না। ভুজ্যির জন্য শুধু আটকে আছি।
- তুমি তো পুরো খাসা জিনিস..!! ভুজ্যি ছাড়া চলে যাওনা ওপারে,সমস্যা কি?
- না রে সুদিব,যাবো না রে। দে না সুদিব,দে না? আমার নামে একটা ভুজ্যিই তো। আমিও স্বর্গে যেতে পারি তাহলে।
সুদেব উঠে দাঁড়ালো। কম্ম সাবাড় হয়েছে।
.
.
.
নিতাই চোখ কপালে তুলে বললো,
- কি রে সুদেব,একদম সুস্থ মনে হচ্ছে? যা জ্বরে পড়েছিলি,ভাবলাম একমাসের আগে তো উঠতেই পারবি না।
- বাদ দে ওসব। চল আমার সাথে।
- কোথায় যাবো?
- বামুন ঠাকুরের বাড়ি।
- কেনো রে? পূজা লেগেছে নাকি তোর বাড়ি?
সুদেব উত্তর দিলো,
- আরে না। গায়ে একটা ভুজ্যি উচ্ছুগ্গু না দিলে চলে কেমন করে? শালা নামেও হ্যাংলা,কাজেও হ্যাংলা..!!
Subscribe to:
Posts (Atom)