আসছে....


(১)

নীলাদ্রি জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বাতি নেভানো,কিন্তু সবকিছু দিব্যি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো জানালার গরাদ ঠিকরে ভেতরে ঢুকে পড়ছে। নীলাদ্রি খুব নিচু স্বরে গান গাইছে।
                   
                                       চাঁদের আলো কালো ঘরে,
                                          ঢুইকা আমায় কয়-
                                        কালো ঘরে কালো তনু,
                                         প্রাণে কি আর সয়?

কোথাও হয়তো রাতজাগা এক পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠলো। একঝাঁক বাদুড় নিঃশব্দে জ্যোৎস্নায় ছায়া ফেলে উড়ে যাচ্ছে। নীলাদ্রি গান থামিয়ে ফেললো হঠাৎ। তার কান্না পাচ্ছে। হাসনাহেনার তীব্র ঘন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।

তার মন আজ খুব খারাপ। কি কারণে খারাপ,সে জানেনা। বেশিরভাগ সময়ই অকারণে মন খারাপ হয়। নীলাদ্রি জানে,পৃথিবীর কোনো কিছুই কারণ ছাড়া হয় না। অকারণে মন খারাপের পেছনেও একটা কারণ থাকে। বেশিরভাগ সময়ই সেটা কেউ বুঝতে পারেনা,কিংবা বুঝতে পারলেও মনে করতে বা বলতে চায় না।

নীলাদ্রির ঘোর হঠাৎ কেটে গেলো। ডাইনিং রুমে চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাবা'র গলা। নীলাদ্রি জানালার কাছ থেকে সরে এলো। বাবাকে থামাতে হবে। নাহলে প্রেশার উঠিয়ে ডাক্তার-হাসপাতাল বাঁধাবে।


(২)

আকবর সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। বেশ কায়দা করে তাকে শান্ত করতে হয় নীলাদ্রির। এর আগে,রাগের কারণে চিৎকার করতে গিয়েই স্ট্রোক-টা করেছিলেন। স্ট্রোকের পর থেকে নীলাদ্রি বহু বুঝিয়ে-শুনিয়ে তবেই বাবার মাথা ঠান্ডা করে। মেয়ে ছাড়া অন্য কেউ ঠান্ডা করতে এলে এক চড়ে উল্টো তাকেই ঠান্ডা করে দেন আকবর সাহেব। এমনকি সে হোসনেআরা বেগম হলেও।

- এবার বলো বাবা,চেঁচাচ্ছিলে কেনো?

- এমনিই। তুই যা মা,ঘুমো গিয়ে।

- ঠিকাছে বাবা,আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। তুমিও শুয়ে পড়ো। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আর চেঁচামেচি করোনা। শরীর খারাপ হবে।

- ঠিকাছে রে মা,তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো গিয়ে।

নীলাদ্রি উঠে চলে গেলো। আকবর সাহেব ক্লান্তকর একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ কিসের জন্য এতো চেঁচামেচি,জানার জন্য দ্বিতীয়বার আগ্রহই প্রকাশ করলো না মেয়েটা। কোনো কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই তার। সবসময় কৌতুহল থেকে বিরত রাখে নিজেকে। এভাবে চলতে থাকলে তো একসময় জগৎ-সংসারের উপর থেকে মায়া উঠে যাবে মেয়েটার।

হোসনেআরা বেগমের মুখ থমথম করছে। খানিকটা ভীত গলায় আকবর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এখন কি করবে? দাড়োয়ানের মাথা তো মনে হয় খারাপ হয়ে গেছে।

- খারাপ হয়েছে মানে? হারামজাদা খাসা পাগল হয়ে গেছে। সকাল হলেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেবো।

- বের করে দিলে তো রাস্তায় রাস্তায়ই ন্যাংটো হয়ে ঘুরবে।

আকবর সাহেব এবার হোসনেআরা বেগমের দিকে কটমটিয়ে চাইলেন।
- তো কি করবো? বদমাশটাকে ঘরে এনে সাজিয়ে রাখবো?

- ভালো দেখে কোনো একটা মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও?

- আমার অত ঠ্যাকা নেই। বের করে দেবো। যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে গিয়ে ন্যাংটো হয়ে বসে থাকুক।


(৩)

সকাল আটটা বেজে গিয়েছে। নীলাদ্রি তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলো। ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে আর আধঘন্টা পরেই।
দরজা দিয়ে বেরোবার সময়ই লম্বা এক স্যালুট ঠুকলো ইসমাইল। সবগুলো দাঁত বের করে,বিশাল হাঁ করা এক হাসি দিয়ে ডগমগে গলায় বলে উঠলো,
- কাল রাইতে স্যার যা কইছে,সত্যি ছিলো আপা। কিন্তু আমার তাতে দোষ নাই। কি করমু আপা,কন? যা গরম পড়ছে,গতরে কাপড় রাখাই দায়..!!

নীলাদ্রি বলে উঠলো,
- মানে? বুঝলাম না।

- থাক আফা,বুঝন লাগতোনা। যেইখানে যাইতাছিলেন,যান।


(৪)

ম্যানেজার মাইনুর কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন ইলিয়াস সাহেবের সামনে। ইলিয়াস সাহেবের মাথায় আইসব্যাগ ধরে রাখা হয়েছে।

ইলিয়াস সাহেবের অফিসে পোষা একটা ময়না ছিলো। কটকট করে কথা বলতে পারতো। কোনো একটা শব্দ দু'তিন দিন ক্রমাগত শুনতে থাকলে অতি দ্রুত সে শব্দ লুফে নিতে পারে ময়না পাখিরা।

ইলিয়াস সাহেব সারাক্ষণই অফিসে 'মাইনুর-মাইনুর' করতেন। পাখিটাও কেনার এক সপ্তাহের মাথায় কথা বলতে শুরু করে। ম্যানেজার মাইনুর রুমে ঢুকলেই ময়না বলে উঠতো,
- মাইনুর তোর নাম কি? মাইনুর তোর নাম কি?

জবাব না দিলে চিৎকার ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকতো।

ইলিয়াস সাহেব ইদানীং অফিসে যাচ্ছেন না। ছোট ছেলের জন্য বিয়ের পাত্রী দেখছেন। মহাযজ্ঞীয় ব্যাপার..!! ম্যানেজারও এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ময়না পাখিটাকে দিয়ে গিয়েছিলেন অফিসের ড্রাইভার-গার্ডদের মেসে'তে। ফিরে এসে ময়না পাখিকে দেখেই চক্ষু চড়কগাছ..!! এ ময়না আর আগের ময়না নেই। যে'ই সামনে আসছে,ময়নার মুখে একটাই কথা,
- নটির পুত তোর নাম কি? নটির পুত তোর নাম কি?

সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হচ্ছে,পাখিটা ইলিয়াস সাহেবকে দেখার পর থেকে অনবরত এ কথা বলেই যাচ্ছে। ম্যানেজার মাইনুর সারা দিন-রাত চেষ্টা করেও পাখির মুখে অন্য কোনো বুলি ফোটাতে পারছেন না।


(৫)

ইলিয়াস সাহেব বাসায় ঢুকেই রাহেলা বেগমকে ডাকলেন।
- হারামজাদা কি এখনও ঘুমোচ্ছে?

- না,নাস্তা করে বেরিয়েছে।

- তা তো বেরোবেই। অকর্মাদের তো একটাই কাজ,ধ্যাই ধ্যাই করে ঘোরা। তা তোমার বড় পুত্তুর কোথায়? সেও কি ঘুরে বেড়াচ্ছে?

- সে কি? ও না তোমার সাথে অফিসে গেলো?

- হবে বোধহয়,ভুলে গেছি। এক কাপ চা আনো।


(৬)

ইলিয়াস সাহেবের বড় ছেলে যায়েদ। একমনে ফাইলপত্র সই করে চলেছে। সামনের চেয়ারে যে সায়েদ বসে আছে,ভ্রূক্ষেপই নেই।

- এ্যাই দাদা,পালিয়ে যে বিয়ে করেছিলি,ফিলিংস কেমন ছিলো রে?

- হুঁ? কিছু বললি?

- বললাম যে,পালিয়ে বিয়ে করতে অনুভূতি কেমন?

যায়েদ ফাইলপত্র থেকে মুখ তুললো,মুখটা হাসিতে ভরে উঠেছে।
- সত্যি বলবো?

- আমি কি মিথ্যাটা জানতে চেয়েছি?

- অসাধারণ অনুভূতি,পুরো এ্যাডভেন্ঞ্চার..!!

- আর বাসায় ফেরার পর বউয়ের সামনে যে বাবার হাতে থাপ্পড়,সেটা?

যায়েদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার ফাইলে মুখ গুঁজলো।
- তুই আমার রুম থেকে বেরো।

- কেনো? সমস্যা কি?

- বের হতে বলেছি,বেরো। নাহলে ম্যানেজারকে ডেকে বের করে দেবো।

- কাউকে বের করতে হলে গার্ডকে ডাকতে হয়। ম্যানেজারকে নয়।

- তুই যাবি?

- ঠিকাছে,যাচ্ছি তো।

দরজার সামনে গিয়ে সায়েদ আবার ঘুরে দাঁড়ালো।
- আমারও পালিয়ে বিয়ে করার শখ ছিলো। কিন্তু বাবার চড়ের ভয়ে শখ টা আর মিটলোনা।


(৭)

সায়েদ বড় ভাইয়ের রুম থেকে ম্যানেজার মাইনুরের রুমে ঢুকলেন। ম্যানেজার তখনও ময়না কে বুলি পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। সায়েদকে দেখে ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
- কেমন আছেন মাইনুর সাহেব?

- জ্বী ভাইজান,ভালো।

- আপনি আমার বড় ভাইকে স্যার বলে ডাকেন,আমাকে ভাইজান ডাকেন কেনো?

ম্যানেজার অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
- না মানে,আপনি তো অফিসে বসেন না,তাই আর কি..

- শোনেন ম্যানেজার সাহেব,গরুর পুত্র গরুই হয়,বসের পুত্র বস ই হয়।

- জ্বী ভাইজান,আজ থেকে স্যার বলে ডাকবো।

- প্রয়োজন নেই,ভাইজান ই ডাকবেন। গরুর উপমা আমার জন্য প্রযোজ্য না।

- জ্বী ভাইজান,তা তো অবশ্যই।

সায়েদ কতক্ষণ ময়না পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঘুরে চলে যাবে এমনসময় বলে উঠলো,
- আচ্ছা মাইনুর সাহেব,ময়না পাখির মাংস কি খাওয়া যায়?

- জানি না ভাইজান। কেনো?

- খাওয়া গেলে এটাকে রোস্ট বানিয়ে খেয়ে ফেলুন। মিনিটে তো বোধহয় শ'খানেক গালি দিচ্ছে..


(৮)

নীলাদ্রির মন আজ একটু বেশিই খারাপ। পূর্ণিমার শেষ কয়দিনে যখন আলোর ভাটা পড়তে শুরু করে,তখন ও ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। অন্ধকার যেন ওর গায়ের রং-কে আরো গাঢ় করে তোলে। হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গন্ধটা যেন প্রভাবকের কাজ করছে। নাক দিয়ে বুকের ভেতরে ঢুকে চাপা কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নীলাদ্রির অতি পছন্দের সেই লাইনগুলো এখন বড্ডো মনে পড়ছে। সে মিনমিন করে লাইনগুলো সুরে তোলার চেষ্টা করলো-

                                         ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া-
                                           জ্যোৎস্না ধরতে যাই;
                                      আমার হাত ভর্তি চাঁদের আলো,
                                           ধরতে গেলেই নাই..!!

সুর টা হঠাৎ থেমে গেলো। নীলাদ্রির চোখে কিছু একটার নড়াচড়া ধরা পড়ছে। ওর জানালাটা বাসার পেছনের বাগানমুখী। জায়গাটা জংলামত,ঘাসে ভর্তি,বেশ রকমের গাছও আছে। পরিস্কারের অতি প্রয়োজন না পড়লে সচরাচর কেউ যায় না,এত রাতে তো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া স্ট্রীট ল্যাম্পের আবছা আলোয় সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্তই বাগানে আলো-আঁধারীর খেলা চলে যেন।

নীলাদ্রি জানালা দিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। একজন মানুষের ছায়াকে দেখা যাচ্ছে,মনে হচ্ছে হাঁটছে। দূরে কোথাও রিক্সার ক্রিংক্রিং শব্দ হলো। নীলাদ্রি বিদ্যুৎবেগে জানালা থেকে সরে এলো।

লোকটি অন্ধকার থেকে আবছা আলোতে এসেছে,চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গায়ে কোনো কাপড় নেই..!!

(এখনও ইচ্ছে করেই শিরোনাম দিইনি গল্পটির,হয়তো কোনো একদিন বাকী অংশটুকু লিখে শিরোনাম দেবো। এটুকু পড়ার পর খেপে যাওয়া,পড়তে ইচ্ছুকগন,ইনবক্স কিংবা কমেন্টে গালাগালি করতে পারেন। আমার গল্পের পাঠক আবার খুবই কম। গালাগালির পরিমাণও তাই শূন্য।)





No comments:

Post a Comment