- জ্বী।
- আর হ্যাবলার মতো তাকায়া থাকবা না আমার দিকে, অসহ্য লাগে। স্মার্ট হতে চেষ্টা করো; বুঝছো?
- জ্বী, বুঝেছি।
- কী সেই কখন থেকেই জ্বী জ্বী করতাছো? গাধা কোথাকার!! রিক্সা ডাকো।
বেশ ঝাঁঝের সাথেই কথাটা বললো ইভা। মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে রায়হান একটা রিক্সা ডাকলো। দুজনেই রিক্সায় উঠে বসলো। উদ্দেশ্য প্রথমে ইভাকে সায়েন্স ল্যাবে নামিয়ে দেয়ার পর রায়হান মেডিকেলে নামবে। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও।
সায়েন্স ল্যাবের সামনে এসে নামার সময় ইভা কটমটিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো, “যতগুলো শর্ত দিয়েছি সকাল থেকে মনে থাকবে তো?”
নিচু গলায় রায়হান বললো, “আশা করি... মানে জ্বী... মানে হ্যাঁ, অবশ্যই।”
- গুড, আজ সন্ধ্যায় ফোন দেয়ার দরকার নেই; আমার রাগ না কমা পর্যন্ত কথা বলতে চেষ্টা করবা না আমার সাথে। রাগ কমলে আমিই ফোন দিব। যাও এখন।
“আচ্ছা..”, বলে রায়হান রিক্সাওয়ালাকে সামনে বাড়তে বললো। উপরে উপরে যতই রাগ দেখাক, ছেলেটার প্রতি গভীর টান অনুভব করে ইভা। এমন শান্ত ছেলে আজকের দিনে পাওয়া দুষ্কর। রায়হান দেখতে দারুণ কিন্তু অত্যধিক শান্ত হওয়ায় বোকা টাইপের মনে হয়। ধমক দিয়ে বারবার স্মার্ট হতে বললেও ইভা মনে মনে চায় ও সারাজীবন এমন বোকাই থাকুক।
বিকেল দিকে আকাশ প্রচন্ড মেঘলা হয়ে এলো কালো মেঘে। জোর বাতাস বইছে। কিন্তু বৃষ্টির আগেই ইভা বাসায় পৌঁছে গেল। সন্ধ্যার দিকে তুমুল বৃষ্টি। সেই সাথে ঝড়ো হাওয়া। রাত ৯টা বেজে গেল। রায়হানকে সে ফোন করতে না করেছে সত্যি কিন্তু এই মূহুর্তে চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য। কয়েকবার রায়হানকে ফোনে ট্রাই করলো, সুইচড অফ। ছুড়ে ফোনটা বিছানায় ফেললো।
রাত একটা পঁচিশ; ঘুম আসছে না ওর। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, হয়তো বা হিমেল হাওয়ায় ভাল লাগবে মনে করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালো ইভা। হঠাৎ লনের দিকে চোখ পড়তেই ও দেখলো কেউ একজন দাড়িয়ে আছে। একটা ছেলে; ওর দিকে তাকিয়েই হাত নাড়ছে!
তখনই বজ্রপাতের আলোয় রায়হানকে চিনতে পারলো ও। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে জুবুথুবু হয়ে গেছে!
দৌড়ে নিচে নেমে এলো ইভা। রায়হানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ও। কিছু না বলে রায়হান একগুচ্ছ সাদা গোলাপ বাড়িয়ে দিলো ইভার দিকে।
- শুভ জন্মদিন।
প্রচন্ড অবাক হয়ে গেছে ইভা। ওর মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। ফুলগুলো হাতে নিয়ে কি বলবে ভেবে না পেয়ে বললো,
- এই ঝড় বৃষ্টিতে এসবের মানে কি রায়হান?
- না, মানে... তোমার জন্মদিন তো... তাই ভাবলাম..
হেসে উঠলো ইভা, “তুমি সত্যিই একটা পাগল, না না গাধা। কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছো এখানে?”
- দেড় ঘন্টার মত হবে।
- বাসায় যাও এখন।
- এখনই?
- তাহলে কখন? বৃষ্টিতে ভিজবো নাকি সারারাত? আব্বু জেগে উঠলে সমস্যা। বাসায় যাও।
- আচ্ছা, যাই তাহলে।
হাঁটা ধরেও আবার ফিরে আসলো ও। মিনমিনিয়ে বললো, “একটা কথা....”
- কি?
- রাগ কমেছে?
ইভা মুচকি হেসে বললো, “চুপচাপ বাসায় যাও।”
“আচ্ছা..”, বলে রায়হান ফেরার পথ ধরলো। যতক্ষণ পর্যন্ত ওকে দেখা গেলো ইভা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েই রইলো। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে জামা পাল্টে নিলো ইভা। বিছানায় এসে ফুলগুলো হাতে নিলো ও। বৃষ্টিতে একটানা ভিজে সাদা গোলাপগুলো আরো কোমল ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে যেন, হালকা মিষ্টি একটা গন্ধও ছড়াচ্ছে। কি মনে করে যেন ফুলগুলোকে বুকে চেপে ধরলো ও; ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ইভা কাঁদছে। কেন জানি মনে হচ্ছে রায়হানকে ছাড়া বাঁচা ওর পক্ষে অসম্ভব।
.
.
.
আজ রায়হানকে দেখা গেলো একদম রিক্সা রেডি করে দাড়িয়ে আছে। ওর মুখে সেই চিরচেনা এক চিলতে হাসি। ওর হাসি দেখে ইভাও মুচকি না হেসে পারলো না। রিক্সায় উঠে বসলো দুজনেই। কথা বলার এক পর্যায়ে ইভা লক্ষ্য করলো রায়হানের গায়ে খুব জ্বর আর ওর ডান হাতের কনুইয়ের উপর শার্টের হাতা রক্তের লাল রংয়ে ভেজা।
.
.
আজ রায়হানকে দেখা গেলো একদম রিক্সা রেডি করে দাড়িয়ে আছে। ওর মুখে সেই চিরচেনা এক চিলতে হাসি। ওর হাসি দেখে ইভাও মুচকি না হেসে পারলো না। রিক্সায় উঠে বসলো দুজনেই। কথা বলার এক পর্যায়ে ইভা লক্ষ্য করলো রায়হানের গায়ে খুব জ্বর আর ওর ডান হাতের কনুইয়ের উপর শার্টের হাতা রক্তের লাল রংয়ে ভেজা।
‘কি হয়েছে..’ -জিজ্ঞেস করতেই রায়হান এড়িয়ে গেলো। জ্বরটা বৃষ্টিতে ভেজার ফলেই হয়েছে, তা জানে ইভা। অনেকটা জোড় করেই ওর শার্টের হাতা উঠালো ইভা। কনুইয়ের উপরের অংশটা খুব খারাপভাবেই ছড়ে গেছে। কটমটিয়ে চাইতেই রায়হান নিচু স্বরে বললো, “না,মানে.. কাল তোমাদের দেয়াল টপকাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। বেশি লাগেনি তো।”
- চুপ কর তুমি। রিক্সা ঘোরাতে বল।
- কোথায় যাবে? ক্লাস করবে না আজ?
- আমি রিক্সা ঘোরাতে বলেছি।
অগত্যা ঘোরাতেই হলো। রিক্সা থেকে নেমে রেললাইনের ধার দিয়ে হাঁটতে লাগলো ওরা। রায়হান খেয়াল করলো ইভার গাল বেয়ে পানির ধারা নামছে। নিঃশব্দে কাঁদছে ও। কি হয়েছে বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পেলো না রায়হান।
একটু পর ইভা জিজ্ঞেস করলো, “কাল সন্ধ্যা থেকে তোমার ফোন বন্ধ ছিলো কেন? কোথায় ছিলো ফোন?”
- পকেটেই ছিলো। বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে ফোনটা।
- সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টিতে ভেজার কারণ?
- সাদা গোলাপ খুঁজে পাচ্ছিলাম না.... তাই আর কি...
- যদি কাল ব্যালকনিতে না আসতাম কি করতে?
- ভোর অবধি অপেক্ষা করতাম।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইভা বলে উঠলো, “রায়হান...”
- হুম, বলো?
- কতটা ভালবাসো আমায়?
- আমার পক্ষে যতটা সম্ভব।
- কেমন ভালোবাসো?
মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে রায়হান উত্তর দিলো, “নিঃশর্তে ভালবাসি।”
হঠাৎ ইভা ওর কাধেঁ হেঁচকা টান অনুভব করলো। একটা লোক ওর ভ্যানিটিব্যাগ টান দিয়ে রেললাইনের উপর দিয়েই দৌড় দিলো সামনের দিকে।
“আমার ব্যাগ...!!!”, চেঁচিয়ে উঠলো ও।
ইভাকে ‘দাঁড়াও’ বলে রায়হানও দৌড়ে লোকটার পিছু নিলো। বেশ খানিকটা দূরে গিয়েই লোকটাকে ধরে ফেললো ও। শুরু হলো ধ্বস্তাধ্বস্তি। অনেকটা দূর থেকেই ইভা চেচাচ্ছে, “কেউ আছেন? সাহায্য করুন,কেউ আছেন?”
চারদিকে কেউ নেই। তীক্ষ্ম বাঁশির শব্দে পেছনে তাকিয়ে ইভা শুধু দেখতে পেলো দূর থেকে ট্রেন আসছে। চেঁচিয়ে ইভা বললো, “রায়হান, ছেড়ে দাও, ট্রেন আসছে।”
কিন্তু ওর গলার স্বর এতদূর অবধি পৌঁছোলো না।
ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে রায়হান ওর দেহে প্রচন্ড জ্বালা অনুভব করলো। লোকটা ওর বুক ও পেটে ছুরি চালিয়েছে।
তীব্র যন্ত্রনায় রেললাইনের উপর লুটিয়ে পড়লো ও। লোকটা এই সুযোগে ছুট দিলো। রায়হান ঝাপসা চোখে দেখতে
পেলো অনেক দূর থেকে ইভা ওকে রেললাইন থেকে সরে যেতে বলছে।
কিন্তু রায়হানের এখন সেই শক্তিও নেই।
সব ঝাপসা হয়ে আসছে। ইভা প্রাণপনে দৌড় দিলো রায়হানের দিকে। ট্রেন কাছে চলে এসেছে। আরো জোরে ছুটলো ও। ট্রেন আরো কাছে এসে পড়েছে। ঘন ঘন হুইসেল শুনতে পাচ্ছে ও। সর্বশক্তি দিয়ে দৌড় দিলো ইভা, আর চেঁচিয়ে রায়হানকে সরতে বলছে। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল ইভা। ও দেখলো ট্রেন ওর পাশ দিয়ে ওকে অতিক্রম করে রায়হানের দিকে ছুটে চলেছে। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলো ইভা। ট্রেন চলে যাওয়ার পর,জ্ঞান হারানোর আগ মূহুর্তে ও শুধু রায়হানের গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত দেহটা দেখতে পেলো রেললাইনের উপর।
.
.
.
বারো মাস পেরিয়ে গেছে। আজ ইভার জন্মদিন।
.
.
বারো মাস পেরিয়ে গেছে। আজ ইভার জন্মদিন।
মানসিক হাসপাতালের নিজের রুমের ঘড়িতে রাত একটা পঁচিশ দেখতে পেলো ইভা। রায়হানের স্টেথিস্কোপটা ওর কাছে রয়ে গেছে।
মুচকি হাসি দিয়ে ইভা কানে দিল সেটা। ও শুনতে পেলো কে যেন বহুদূর থেকে ফিসফিসিয়ে বলছে, “নিঃশর্তে ভালোবাসি..।”
প্রকাশিত হয়েছিলো: ভালোবাসার গল্প গ্রুপে