কালদেবতার পাহাড়



- শূকর,চুমু খাবে আমায়? তাহলে জন্ম পরিবর্তন করো। এজন্মে শূকরের ঠোঁটে চুমু খাই কি করে..!!

কথাগুলো যখন উন্নত বুক থেকে স্বরথলি চিড়ে অট্টহাসির সাথে বেরিয়ে আসছিলো জুলিয়ার,আর্মেতাস তখনও কুঁজো পিঠটাকে সোজা করতে চেয়ে পারছিলো না। তার মুখে প্রচন্ড যন্ত্রণার ছাপ দেখেছিলাম সেদিন আমি।

ভেনিসের সবচেয়ে দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম আমি। ফিদালেলের সবচেয়ে কুৎসিত যুবকটাও আমার সাথেই পড়তো। ভাগ্যিস বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। নয়তো ওর কুৎসিত দেহটা দেখলেই না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া হতো।

হাড়ের সাথে কালো বিষ্ঠার মতো লেগে থাকা চামড়ায় যেন সবার ঘেন্না ছিটকে পড়তো। ঘেন্নাটা তীব্রতর হতো ওর কুঁজো পিঠটায়। খর্বাকার আর্মেতাসের রোম সাম্রাজ্যের চিহ্ন-থ্যাবড়ানো নাকটা একটু অধিক বড় ছিলো বলেই হয়তো চেহারাটা শূকরের ন্যায় লাগতো কয়েকজনের কাছে। আমার কাছেও তাই ই মনে হতো। তবে এই কুৎসিত মানুষটাও আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলো শুধু ওর চোখের জন্য।

আর্মেতাসের কদাকার মুখে ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া। যে চোখের অভিজ্ঞতা আছে ভারতের রেইন ফরেস্ট থেকে শুরু করে তিব্বতের পর্বত,সব কিছু। সে চোখে যেন আমি ভারতের নাগা সন্নাসী যারা লিঙ্গে কেজি বিশেক ভার টানতে পারে থেকে শুরু করে তিব্বতের লামাদের শতবর্ষীয় যৌবনের গুপ্তসূত্র দেখেছিলাম। আর্মেতাসের চোখ ঠিকরে যে বুদ্ধির ধারা ঝড়তো সে ধারায় যেন গোটা বিশ্বকে দেখতে পেতাম আমি..!!
.
.
.
সেদিন লাইব্রেরীতে বসে হান্স ক্রিশ্চিয়ানের জীবনী পড়ছিলাম। আর্মেতাস ঘরে উঁকি দিলো। আমি তাকে দেখে একগাল হেসে বললাম,
- এসো আর্মে,কি খবর তোমার? বসো।

সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে আর্মেতাস বললো,
- আমায় একটা ঘোড়ার গাড়ি দিতে পারো,মার্কো?

- তা না হয় ব্যবস্থা হবে ক্ষণ। কিন্তু যাবে টা কোথায়?

- ওকলায়েমো সিঁতেরা'য়।

আমি রীতিমতো ধ্বাক্কা খেলাম। চোখজোড়া যেন কপালে উঠলো। গলার স্বর নিচু করে বললাম,
- মানে? কেনো? ওই জায়গাটা তো অভিশপ্ত। বাবার কাছে শুনেছি,কালদেবতার পাহাড় সেখানে। ওখানে যাবে কেনো?

- দরকার আছে।

- কি দরকার?

- না জানলেই কি নয়? দিতে পারবে নাকি সেটাই বলো।

- ও পাহাড়ে যেতে গিয়ে যদি ঘোড়া মরে যায়?

- অতদূর লাগবেনা। আর ক্ষতি হলেও পুষিয়ে দেবো।

আমি হেসে বললাম,
- ঠাট্টা করছিলাম। তোমার জন্য ঘোড়া মরলেও ক্ষতি নেই। আমি কি যেতে পারি সঙ্গে?

আর্মেতাস খানিকক্ষণ ইতস্ততা করে বললো,
- ঠিকাছে। পরশু রওনা দেবো।

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,তা হলে দুটো ব্র্যান্ডি হয়ে যাক?

আর্মেতাস কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম,নিশ্চয়ই বড়সড় কিছু ঘটেছে।
.
.
.
দুদিন পর রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে বেশ ভালোভাবেই আঁটঘাট বেঁধে রওনা দিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। আর্মেতাসকে বেশ চিন্তিত লাগছিলো।

- তোমায় বেশ চিন্তিত লাগছে আর্মে। আমায় বলা যায় না ব্যাপারটা?

- বের হয়েছো যখন,একসময় না একসময় তো জানতেই পারবে মার্কো।

- তবে এ প্রসঙ্গ আপাতত বাদ। কিন্তু কালদেবতার পাহাড়ে পৌঁছবো কিভাবে?

আর্মেতাস একটা ম্যাপ মেলে ধরলো সামনে। আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে লাগলো। প্রথমে ঘোড়ার গাড়িতে আলেসান্দ্রো শহরের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামবো। তারপর একদিন হাঁটতে হবে গুইসিপ্পির প্রান্তর ধরে। প্রান্তের শেষে যে গিরিখাত আছে সেটা পেড়িয়ে গেলেই লুইগির জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে তা ধরে এগোলে তিনদিন পর ওলাপ্পা গ্রাম। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিলেই দেখিয়ে দেবে।

- ম্যাপে কালদেবতার পাহাড় কোথায়?

- বই পুস্তকে ওলাপ্পা গ্রাম পর্যন্তই দেয়া আছে। কালদেবতার পাহাড় মুখে মুখে প্রচলিত।

- ও পাহাড় যে সত্যিই আছে তার প্রমাণ কি?

- তুমি এখন আলেসান্দ্রো শহরে আছো তার প্রমাণই বা কি?

- আমার গাড়ির জানলা খুললেই তো বোঝা যাবে।

আর্মেতাস মুচকি হেসে বললো,
- তাহলে আমারটাও ওলাপ্পা গ্রামে পৌঁছলেই বোঝা যাবে।

আর্মেতাসের দূর্দান্ত কথার কাছে সর্বদাই আমি হেরে যাই। একগাল হাসা ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকেনা। এবারও তাই ই করলাম। হেসে বললাম,
- তা আমাজনে রাত কেমন কাটালে?

আর্মেতাস জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
- ভালোই,রেড পাইথনের সাথে রাত কাটিয়েছি আর কি।
.
.
.
পাঁচদিন যাত্রার পর কাঁদা-জংলা পেড়িয়ে অবশেষে ওলাপ্পা গ্রামে পৌঁছলাম। হলুদ মাটির বিরান এই প্রান্তরেই মেগেরীন উপজাতির বাস।

দুধ,কিউবার্তের ফল খাইয়ে আর হাতির বিষ্ঠা মাথায় ছুঁইয়ে বরণ করা হলো আমাদের। এখানে হাতিদের পবিত্র প্রাণী মনে করা হয়। একরাত থাকার পর যখন জানালাম যে আমরা ওকলায়েমো সিঁতেরা'য় যেতে চাই,ভয়ার্ত কন্ঠে মেগেরীন রাজা আমাদের যেতে নিষেধ করলেন। ওই অভিশপ্ত পাহাড়ে গেলে নাকি ভ্রমণকারীর গায়ে অভিশাপ পড়ে। কালদেবতার অভিশাপ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে সারা জীবন জুড়ে।

আর্মেতাস সেসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে পাহাড়ের ঠিকানা জেনে যাত্রা শুরু করলো। আমাদের বিপদ যাতে কিছুটা কমে সেজন্য মেগেরীন রাজা হাতির দাঁত থেকে তৈরি একজোড়া ব্রেসলেট পড়িয়ে দিলেন।

তিনরাত-তিনদিন একটানা ঘন জংলার পথ পাড়ি দিলাম আমরা। গোটা পন্ঞ্চাশেক জোঁক,দশখানা সাপ,গোটা তিনেক কুমিরের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর নিজেদেরই কালদেবতা মনে হচ্ছিলো। কাঁদামাটিতে মাখা মুখ আর জায়গায় জায়গায় ছড়ে যাওয়া আমায় বীভৎস লাগছিলো বেশ। আর্মেতাসের কথা তো বাদই দিলাম।

যেদিন জংলা বাদে উঁচু উঁচু ভূমি দেখতে পেলাম,সেদিন বুঝলাম যে,ওকলায়েমো সিঁতেরা'য় পৌঁছে গেছি। দুপুর নাগাদ সে বিশাল পাহাড়ের সন্ধান পেলাম।

এই সেই কালদেবতার পাহাড়..!!

পাহাড়ের ধারে আসতে আসতে সূর্য হেলে পড়লো। আর্মেতাস এমনিতেই স্বল্পভাষী মানুষ,তার উপর দুপুর থেকে একদমই চুপ করে গেছে। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিচ্ছেনা,শুধু হেঁটেই চলেছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা নেমে এলো। দেখলাম আর্মেতাস এক গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

- আমাদের কি এই গুহামুখে ঢুকতে হবে এখন?

আর্মে জবাব দিলো,হ্যাঁ।

- তুমি কি এই জায়গাটা আগে থেকেই চেনো?

- না।

- তাহলে এতো অনায়াসে বের করে ফেললে যে?

- মেগেরীন রাজা বলেছে,এরকম শত শত গুহামুখ এই পাহাড় জুড়ে আছে। সবকয়টাই এক জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়েছে।

আমি ততক্ষণে অভিযানে নতুন মোড় পেয়ে গেছি। উৎফুল্ল হয়ে বললাম,
- চলো তাহলে,ভেতরে ঢোকা যাক?

- মশাল প্রয়োজন।

- সে আমি বানাচ্ছি..
.
.
.
গুহার দেয়াল ধরে হাঁটছি। পিচ্ছিল,শ্যাওলা পড়া,স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। কিলবিল করে কিসব পোকামাকড়েরা দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেয়াল প্রশস্ত হতে লাগলো। লাইমস্টোন চোখে পড়লো। তার মানে সামনেই কোথাও পানির স্রোত আছে।

একসময় সত্যিই পানির স্রোতের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু এ কি..!! এ তো পানির স্রোত নয়। দুধের মত সাদা তরল পদার্থ বয়ে চলেছে নালা ধরে।

আর্মেতাস একটা বয়াম বের করে খানিকটা তরল পদার্থ পুরলো। সেটা ব্যাগে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
- চলো,ফেরা যাক।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,ও বস্তু কি?

আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- আথ্রোপেড্রো। চিরযৌবন পানি।

আমি ফিক করে হেসে শুধোলাম,
- তোমার জন্য?

- না,জুলিয়া চেয়েছে।

এতসব পাগলামি আর তীব্র বিশ্বাসের বহর দেখে হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে ওর পিছু পিছু গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম।
.
.
.
ভ্যালেন্টিনার মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর্মেতাস আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। খট খট শব্দ তুলে জুলিয়া এসে সামনে দাঁড়ালো।
- কি হে শূকর,এনেছো আথ্রোপেড্রো?

আর্মেতাস বয়াম টা বের করে জুলিয়ার হাতে দিলো। জুলিয়া ক্ষিপ্রবেগে যেন বয়ামটা হাতে নিয়ে নিলো।
- সত্যিই আথ্রোপেড্রা তো?

আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- শূকরেরা কখনও ধোঁকা দেয়না।

জুলিয়া অট্টহাসি হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো,
- তা যা বলেছো। মনোবাসনা পূর্ণ করবে? সুযোগ দিচ্ছি আমি।

- কি সেটা?

- চুমু খাবে আমায়?

আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- ক্ষণস্থায়ী রূপে চুমু খাবো কেনো? আথ্রোপেড্রা টা পান করো। দীর্ঘস্থায়ী রূপেই চুমু খেতে দিও।

জুলিয়া হেসে বললো,
- সে না হয় শূকরের একটা ইচ্ছে চিরযৌবনা হওয়ার পরেই পূরণ করবো ক্ষণ।

পরমুহুর্তেই বয়ামের ঢাকনা খুলে এক চুমুকে সম্পূর্ণ তরলটাই গলাধঃকরণ করে ফেললো জুলিয়া।

আর্মেতাস চোখ বড় বড় করে জুলিয়ার পান করার দৃশ্য দেখলো। ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ায় এই প্রথম আমি অন্যকিছু দেখতে পেলাম যেটা আমায় কিছু লুকিয়েছে।
.
.
.
মন্দিরের রাস্তা ধরে হাঁটছি। আর্মেতাসও আমার পাশে পাশে হাঁটছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। এই মুহূর্তে ওকে ঠিক শূকরের মতোই লাগছে।

উত্তরে বেশ দারুণ বাতাস বইছে। তীব্র মাথা ঘুরোচ্ছে। কি ঘটে গেলো,এখনও বুঝতে পারছি না। তাজা বাতাসের জন্য বুক ভরে একটা শ্বাস নিতেই বমি করে ফেললাম।

মন্দিরের মাংসপঁচা গন্ধ টা এখানেও এসে পড়েছে..!!


লা বেস্টিয়া লুইস


- প্রমাণিত হওয়া খুনীর ১৩৮ টি খুনের শেষ ৬ টি'র বর্ণনা তুলে ধরছি জুরি বোর্ডের সামনে।

কথাটি বলে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন এ্যাডি। গত দুইদিন ধরে ১৩২ টি খুনের রেকর্ড পড়ে শোনাতে হয়েছে তাকে। স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত সে।

গ্যাব্রিয়ানো বলে উঠলেন,
- শুয়োর জানি কয়টা খুন করেছিলো?

- ধারণা করা হয় চার'শ টা। প্রমাণাদি মিলেছে ১৩৮ টা।

- নাম কি হারামজাদার?

এ্যাডি এইবার গ্যাব্রিয়ানোর দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালেন।
- আপনার বোধহয় এইবার অবসর নেয়া উচিত গ্যাব্রিয়ানো। গত দুইদিনে আসামীর নাম শতবার উচ্চারিত হয়েছে।

- আহা,বলোই না? অবসরের বাকি আরও তিন বছর। বয়সও হলো। বুঝোইতো..

- অপরাধীর নাম লুইস গারাভিতো।

- ও আচ্ছা। চলো তাহলে শুরু করা যাক?

এ্যাডি মাথা ঝাঁকিয়ে ফাইল খুলতে শুরু করলো।
.
.
.
১৯৮৭ এর ৩'রা মে।

দুপুর দু'টো বাজে। নিজের গাড়িতে বসে আছেন মিগুয়েল নামের এক ধনকুবের। হঠাৎই এক লোক এসে মাথায় রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গাড়ির চাবি চাইলো। মিগুয়েল গাড়ির চাবি না দিয়ে চিৎকার করতে চাওয়ার আগেই ট্রিগারে চাপ পড়লো।

গুলি বের হওয়ার আগে খুনি নিজেই 'ডাকাত-ডাকাত' বলে চিৎকার শুরু করলো,লোক জমায়েত হতে হতে তিনটে গুলিও বেরিয়ে যায়,পরে শত শত লোকের ভিড়ে স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে গেলো সে।

কোনো দৌঁড়ঝাঁপের পলায়ন নয়। কেউ জানতেও পারলোনা যে খুনী তাদের মধ্যেই মিশে গেছে।
.
.
১৯৮৭ এর ২৭'শে আগস্ট।

'সি মন্টিগো' হোটেলে ভ্যালেরিয়া এই মাত্র বিছানা ছেড়ে উঠলো। লুইস নামের এই ভদ্রলোকটা বদমাশের এক হাত। এই নিয়ে দু'ঘন্টায় তিনবার করলো। তাও জোর করে।

টাকা চাইতেই লোকটা বলে উঠলো,
- কিসের টাকা?

- মানে? একবারের কথা বলে একরাতেই তিনবার মেরে দিলে। টাকা দাও,তোমার সাথে শোয়া আর সম্ভব না। এর আগেও তুমি টাকা দাওনি।

- টাকা তো নেই সোনা।

- তুমি টাকা দেবে নাকি আমি চিৎকার করে লোক ডাকবো?

লুইস হেসে বললো,
- ডাকো তাহলে?

চিৎকার করার পূর্বমুহূর্তেই ভ্যালেরিয়ার গলা চেপে ধরলো একজোড়া বজ্রমুঠি।

এক ঘন্টা পর হেলতে-দুলতে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
.
.
১৯৮৭ এর ২৫'শে নভেম্বর।

নভেম্বরের রাত। বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়েছে। সোফিয়া দ্রুতবেগে হাঁটছে। কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে তার,কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছেনা সে।

রাতের খাবার শেষে ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে উঠে এলো লোকটি। পাশে রাখা বালিশটা মুখের উপর চেপে ধরলো সর্বশক্তি দিয়ে। মিনিটখানেক পর ছুড়ি দিয়ে উদভ্রান্তের মত সোফিয়ার জামা ছিড়তে শুরু করলো খুনি। তার মুখে লেগে আছে বিকৃত এক হাসি।

এক সপ্তাহ পরে 'হেরনান হোটেল' কক্ষের ফ্রিজে রুম ক্লিনার এক তরুণীর মাথা আবিস্কার করলো। আস্তে আস্তে কাটা হাত-পা,অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেরিয়ে আসতে লাগলো।

রুম টি ভাড়া নেয়া হয়েছিলো লুইস গারাভিতো'র নামে।
.
.
১৯৮৮ এর ১৭'ই ফেব্রুয়ারি।

সেন্ট্রাল পার্কের ভেতর দিয়ে হাঁটছেন মারিয়ানা। সত্তর বছর বয়সেও দিব্যি হাঁটতে পারছেন বলে নিজের উপর বেজায় সন্তুষ্ট তিনি। দিনের বেলা জনমানুষে ভর্তি থাকে বলে সন্ধ্যার পরেই নির্জনে হাঁটতে পছন্দ করেন তিনি।

হঠাৎ করেই পেটে ধারালো কিছুর আঘাতে বসে পড়লেন মারিয়ানা। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। চিৎকার করতে চেয়েও করতে পারলেন না। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। উঠে দাঁড়াবার চেস্টা করতেই নাড়িভুড়িগুলো পেটের চেরা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তা ভরিয়ে ফেললো।

শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে ঝাপসা চোখে দেখতে পেলেন কেউ একজন নাড়িভুড়িগুলো হাতে নিয়ে মুখে পুরছে আর চিবোচ্ছে।
.
.
১৯৮৮ এর ১২'ই জুন।

প্রাইসের ডিভোর্স হয়েছে একমাস হলো। এখন নিজেকে অধিক সুখী লাগে তার। নিত্যদিন ঝগড়া-বিবাদের চেয়ে স্থায়ীভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।

দুপুরের দিকে দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দিলো প্রাইস। মাথা কামানো একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঢুকলেন ঘরে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
- ঘরে সেলাই মেশিন আর স্যুপ বানানোর কেতলি আছে ইয়াং ম্যান?

মাথা কামানো ভদ্রলোক এতক্ষণে হাঁপিয়ে গেছেন। মানুষের চামড়া এর আগে ছাড়াননি কখনো। এ ছাঁইপাশ চামড়া দিয়ে কুশন আর পাপোস হবে কি না কে জানে..!! স্যুপ-টা একটু দেখে আসা যাক।

রান্নাঘরে এসে হাসি ফুটলো তার মুখে,প্রাইসের মাথাটা বেশ ভালোই সিদ্ধ হয়েছে। মগজ-ঘিলু সব নাক,কানের ফুঁটো দিয়ে বেরিয়ে এসে পানিতে মিশে যাচ্ছে। একটু লবণ চেখে দেখা দরকার।
.
.
১৯৮৮ এর ৮'ই ডিসেম্বর।

রসায়নবিদ নিকোলাস,স্যুয়ারেজ লাইন পরীক্ষা করতে গিয়ে গলিত মাংসপিন্ড পেলেন। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন,তা এসিডে গলিত মাংসপিন্ড।

স্যুয়ারেজ পাইপ ধরে নির্জন এক রেস্ট হাউজ পর্যন্ত পৌঁছলেন তিনি। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন,গোটা বিশেক জারে হাইড্রোক্লোরিক এসিডে ডোবানো শিশুর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আস্তে আস্তে গলে গলে বিশ্রী মাংসপিন্ডে পরিণত হচ্ছে সেগুলো।

ঠিক সেই মুহূর্তেই মাথা কামানো এক মধ্যবয়স্ক লোক ঘরে প্রবেশ করলো। নিকোলাসের হাতে রডের ভারী টুকরো টা ধরা ছিলো তখনও।
.
.
.
বোগোতায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে এলো। এই শহরের ট্রেনগুলোর যাচ্ছেতাই অবস্থা।

চেয়ারে আয়েশ ভঙ্গিতে বসে আছেন এ্যাডি। তার মুখোমুখি বসা লুইস গারাভিতো।
- লুইস,তুমি কি জানো,দুনিয়ার সবচেয়ে কম শাস্তির জেলখানায় আছো তুমি?

- আমার চোখ বাঁধা ছিলো। এই জেলখানার নামই জানিনা এখনও।

- তুমি আছো কলম্বিয়ার 'লা মডেলো' কারাগারে।

- ও আচ্ছা।

- তোমার সাজা হয়েছে মাত্র ত্রিশ বছরের। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ হলে সাজা হতো নয়'শ বছরের যাবজ্জীবন।

- জানি আমি।

- আমি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই। প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে তোমার শাস্তি বাইশ বছরে নেমে আসবে।

লুইস মুখ তুলো এ্যাডির দিকে তাকালো।

- কলোম্বিয়ার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে লাশ শনাক্তের কাজ দেয়া হবে তোমায়। লাশের ব্যাপারে তোমার অভিজ্ঞতা ভালো বিধায় সরকার এ সুযোগ দিচ্ছে তোমায়। ভেবে দেখো।

- আমি রাজি।
.
.
.
জেলখানার বাইরে বেশ শোরগোল হচ্ছে। লুইস জানে,এ আন্দোলন তার বিরুদ্ধেই। কারণ,তার সাজার মেয়াদ ত্রিশ থেকে বাইশ বছর করা হয়েছে। জনগণ এ রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে আর চাচ্ছে,লুইসের জন্য নতুন করে প্রসিকিউশন করা হোক।

লুইস ভালো করেই জানে,সাইকো কিলারদের জন্য নতুন করে প্রসিকিউশন হয় না। কিন্ত আন্দোলনের মুখে সরকার রায় পাল্টাতে বাধ্য হবেই।

লুইসের বেশ হাসি পাচ্ছে এখন। জনগণ বোকা নাকি সরকার নিজেই বোকা বুঝতে পারছেনা সে।
.
.
.
তিন মাস পেড়িয়ে গেছে। লুইস এখন 'ডেথ মন্টানার' কারাগারে। কলোম্বিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার।

তোষকের নিচ থেকে "দি ডেইলি টাইটানিয়া" পত্রিকার কাটিং-টা বের করলো সে। তিনমাস আগের পত্রিকা। তাতে বড় বড় অক্ষরে ছাপানো আছে,

"লা মডেলোর কারাগারে একই সেলে ২৫জন কয়েদীর রহস্যজনক মৃত্যু এবং সাইকো কিলার লুইস গারাভিতোর পলায়ন..!!"