এ শহরে প্রতিটি ইটের কোণায় লুকিয়ে থাকে গল্প। গল্পরা হাঁটতে জানে না,জানলে আন্দোলন করতো। ওরা আবার ভীষণ অভিমানী..!!
কালদেবতার পাহাড়
- শূকর,চুমু খাবে আমায়? তাহলে জন্ম পরিবর্তন করো। এজন্মে শূকরের ঠোঁটে চুমু খাই কি করে..!!
কথাগুলো যখন উন্নত বুক থেকে স্বরথলি চিড়ে অট্টহাসির সাথে বেরিয়ে আসছিলো জুলিয়ার,আর্মেতাস তখনও কুঁজো পিঠটাকে সোজা করতে চেয়ে পারছিলো না। তার মুখে প্রচন্ড যন্ত্রণার ছাপ দেখেছিলাম সেদিন আমি।
ভেনিসের সবচেয়ে দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম আমি। ফিদালেলের সবচেয়ে কুৎসিত যুবকটাও আমার সাথেই পড়তো। ভাগ্যিস বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। নয়তো ওর কুৎসিত দেহটা দেখলেই না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া হতো।
হাড়ের সাথে কালো বিষ্ঠার মতো লেগে থাকা চামড়ায় যেন সবার ঘেন্না ছিটকে পড়তো। ঘেন্নাটা তীব্রতর হতো ওর কুঁজো পিঠটায়। খর্বাকার আর্মেতাসের রোম সাম্রাজ্যের চিহ্ন-থ্যাবড়ানো নাকটা একটু অধিক বড় ছিলো বলেই হয়তো চেহারাটা শূকরের ন্যায় লাগতো কয়েকজনের কাছে। আমার কাছেও তাই ই মনে হতো। তবে এই কুৎসিত মানুষটাও আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলো শুধু ওর চোখের জন্য।
আর্মেতাসের কদাকার মুখে ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া। যে চোখের অভিজ্ঞতা আছে ভারতের রেইন ফরেস্ট থেকে শুরু করে তিব্বতের পর্বত,সব কিছু। সে চোখে যেন আমি ভারতের নাগা সন্নাসী যারা লিঙ্গে কেজি বিশেক ভার টানতে পারে থেকে শুরু করে তিব্বতের লামাদের শতবর্ষীয় যৌবনের গুপ্তসূত্র দেখেছিলাম। আর্মেতাসের চোখ ঠিকরে যে বুদ্ধির ধারা ঝড়তো সে ধারায় যেন গোটা বিশ্বকে দেখতে পেতাম আমি..!!
.
.
.
সেদিন লাইব্রেরীতে বসে হান্স ক্রিশ্চিয়ানের জীবনী পড়ছিলাম। আর্মেতাস ঘরে উঁকি দিলো। আমি তাকে দেখে একগাল হেসে বললাম,
- এসো আর্মে,কি খবর তোমার? বসো।
সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে আর্মেতাস বললো,
- আমায় একটা ঘোড়ার গাড়ি দিতে পারো,মার্কো?
- তা না হয় ব্যবস্থা হবে ক্ষণ। কিন্তু যাবে টা কোথায়?
- ওকলায়েমো সিঁতেরা'য়।
আমি রীতিমতো ধ্বাক্কা খেলাম। চোখজোড়া যেন কপালে উঠলো। গলার স্বর নিচু করে বললাম,
- মানে? কেনো? ওই জায়গাটা তো অভিশপ্ত। বাবার কাছে শুনেছি,কালদেবতার পাহাড় সেখানে। ওখানে যাবে কেনো?
- দরকার আছে।
- কি দরকার?
- না জানলেই কি নয়? দিতে পারবে নাকি সেটাই বলো।
- ও পাহাড়ে যেতে গিয়ে যদি ঘোড়া মরে যায়?
- অতদূর লাগবেনা। আর ক্ষতি হলেও পুষিয়ে দেবো।
আমি হেসে বললাম,
- ঠাট্টা করছিলাম। তোমার জন্য ঘোড়া মরলেও ক্ষতি নেই। আমি কি যেতে পারি সঙ্গে?
আর্মেতাস খানিকক্ষণ ইতস্ততা করে বললো,
- ঠিকাছে। পরশু রওনা দেবো।
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,তা হলে দুটো ব্র্যান্ডি হয়ে যাক?
আর্মেতাস কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম,নিশ্চয়ই বড়সড় কিছু ঘটেছে।
.
.
.
দুদিন পর রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে বেশ ভালোভাবেই আঁটঘাট বেঁধে রওনা দিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। আর্মেতাসকে বেশ চিন্তিত লাগছিলো।
- তোমায় বেশ চিন্তিত লাগছে আর্মে। আমায় বলা যায় না ব্যাপারটা?
- বের হয়েছো যখন,একসময় না একসময় তো জানতেই পারবে মার্কো।
- তবে এ প্রসঙ্গ আপাতত বাদ। কিন্তু কালদেবতার পাহাড়ে পৌঁছবো কিভাবে?
আর্মেতাস একটা ম্যাপ মেলে ধরলো সামনে। আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে লাগলো। প্রথমে ঘোড়ার গাড়িতে আলেসান্দ্রো শহরের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামবো। তারপর একদিন হাঁটতে হবে গুইসিপ্পির প্রান্তর ধরে। প্রান্তের শেষে যে গিরিখাত আছে সেটা পেড়িয়ে গেলেই লুইগির জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে তা ধরে এগোলে তিনদিন পর ওলাপ্পা গ্রাম। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিলেই দেখিয়ে দেবে।
- ম্যাপে কালদেবতার পাহাড় কোথায়?
- বই পুস্তকে ওলাপ্পা গ্রাম পর্যন্তই দেয়া আছে। কালদেবতার পাহাড় মুখে মুখে প্রচলিত।
- ও পাহাড় যে সত্যিই আছে তার প্রমাণ কি?
- তুমি এখন আলেসান্দ্রো শহরে আছো তার প্রমাণই বা কি?
- আমার গাড়ির জানলা খুললেই তো বোঝা যাবে।
আর্মেতাস মুচকি হেসে বললো,
- তাহলে আমারটাও ওলাপ্পা গ্রামে পৌঁছলেই বোঝা যাবে।
আর্মেতাসের দূর্দান্ত কথার কাছে সর্বদাই আমি হেরে যাই। একগাল হাসা ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকেনা। এবারও তাই ই করলাম। হেসে বললাম,
- তা আমাজনে রাত কেমন কাটালে?
আর্মেতাস জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
- ভালোই,রেড পাইথনের সাথে রাত কাটিয়েছি আর কি।
.
.
.
পাঁচদিন যাত্রার পর কাঁদা-জংলা পেড়িয়ে অবশেষে ওলাপ্পা গ্রামে পৌঁছলাম। হলুদ মাটির বিরান এই প্রান্তরেই মেগেরীন উপজাতির বাস।
দুধ,কিউবার্তের ফল খাইয়ে আর হাতির বিষ্ঠা মাথায় ছুঁইয়ে বরণ করা হলো আমাদের। এখানে হাতিদের পবিত্র প্রাণী মনে করা হয়। একরাত থাকার পর যখন জানালাম যে আমরা ওকলায়েমো সিঁতেরা'য় যেতে চাই,ভয়ার্ত কন্ঠে মেগেরীন রাজা আমাদের যেতে নিষেধ করলেন। ওই অভিশপ্ত পাহাড়ে গেলে নাকি ভ্রমণকারীর গায়ে অভিশাপ পড়ে। কালদেবতার অভিশাপ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে সারা জীবন জুড়ে।
আর্মেতাস সেসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে পাহাড়ের ঠিকানা জেনে যাত্রা শুরু করলো। আমাদের বিপদ যাতে কিছুটা কমে সেজন্য মেগেরীন রাজা হাতির দাঁত থেকে তৈরি একজোড়া ব্রেসলেট পড়িয়ে দিলেন।
তিনরাত-তিনদিন একটানা ঘন জংলার পথ পাড়ি দিলাম আমরা। গোটা পন্ঞ্চাশেক জোঁক,দশখানা সাপ,গোটা তিনেক কুমিরের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর নিজেদেরই কালদেবতা মনে হচ্ছিলো। কাঁদামাটিতে মাখা মুখ আর জায়গায় জায়গায় ছড়ে যাওয়া আমায় বীভৎস লাগছিলো বেশ। আর্মেতাসের কথা তো বাদই দিলাম।
যেদিন জংলা বাদে উঁচু উঁচু ভূমি দেখতে পেলাম,সেদিন বুঝলাম যে,ওকলায়েমো সিঁতেরা'য় পৌঁছে গেছি। দুপুর নাগাদ সে বিশাল পাহাড়ের সন্ধান পেলাম।
এই সেই কালদেবতার পাহাড়..!!
পাহাড়ের ধারে আসতে আসতে সূর্য হেলে পড়লো। আর্মেতাস এমনিতেই স্বল্পভাষী মানুষ,তার উপর দুপুর থেকে একদমই চুপ করে গেছে। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিচ্ছেনা,শুধু হেঁটেই চলেছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা নেমে এলো। দেখলাম আর্মেতাস এক গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
- আমাদের কি এই গুহামুখে ঢুকতে হবে এখন?
আর্মে জবাব দিলো,হ্যাঁ।
- তুমি কি এই জায়গাটা আগে থেকেই চেনো?
- না।
- তাহলে এতো অনায়াসে বের করে ফেললে যে?
- মেগেরীন রাজা বলেছে,এরকম শত শত গুহামুখ এই পাহাড় জুড়ে আছে। সবকয়টাই এক জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়েছে।
আমি ততক্ষণে অভিযানে নতুন মোড় পেয়ে গেছি। উৎফুল্ল হয়ে বললাম,
- চলো তাহলে,ভেতরে ঢোকা যাক?
- মশাল প্রয়োজন।
- সে আমি বানাচ্ছি..
.
.
.
গুহার দেয়াল ধরে হাঁটছি। পিচ্ছিল,শ্যাওলা পড়া,স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। কিলবিল করে কিসব পোকামাকড়েরা দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেয়াল প্রশস্ত হতে লাগলো। লাইমস্টোন চোখে পড়লো। তার মানে সামনেই কোথাও পানির স্রোত আছে।
একসময় সত্যিই পানির স্রোতের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু এ কি..!! এ তো পানির স্রোত নয়। দুধের মত সাদা তরল পদার্থ বয়ে চলেছে নালা ধরে।
আর্মেতাস একটা বয়াম বের করে খানিকটা তরল পদার্থ পুরলো। সেটা ব্যাগে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
- চলো,ফেরা যাক।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,ও বস্তু কি?
আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- আথ্রোপেড্রো। চিরযৌবন পানি।
আমি ফিক করে হেসে শুধোলাম,
- তোমার জন্য?
- না,জুলিয়া চেয়েছে।
এতসব পাগলামি আর তীব্র বিশ্বাসের বহর দেখে হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে ওর পিছু পিছু গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম।
.
.
.
ভ্যালেন্টিনার মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর্মেতাস আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। খট খট শব্দ তুলে জুলিয়া এসে সামনে দাঁড়ালো।
- কি হে শূকর,এনেছো আথ্রোপেড্রো?
আর্মেতাস বয়াম টা বের করে জুলিয়ার হাতে দিলো। জুলিয়া ক্ষিপ্রবেগে যেন বয়ামটা হাতে নিয়ে নিলো।
- সত্যিই আথ্রোপেড্রা তো?
আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- শূকরেরা কখনও ধোঁকা দেয়না।
জুলিয়া অট্টহাসি হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো,
- তা যা বলেছো। মনোবাসনা পূর্ণ করবে? সুযোগ দিচ্ছি আমি।
- কি সেটা?
- চুমু খাবে আমায়?
আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- ক্ষণস্থায়ী রূপে চুমু খাবো কেনো? আথ্রোপেড্রা টা পান করো। দীর্ঘস্থায়ী রূপেই চুমু খেতে দিও।
জুলিয়া হেসে বললো,
- সে না হয় শূকরের একটা ইচ্ছে চিরযৌবনা হওয়ার পরেই পূরণ করবো ক্ষণ।
পরমুহুর্তেই বয়ামের ঢাকনা খুলে এক চুমুকে সম্পূর্ণ তরলটাই গলাধঃকরণ করে ফেললো জুলিয়া।
আর্মেতাস চোখ বড় বড় করে জুলিয়ার পান করার দৃশ্য দেখলো। ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ায় এই প্রথম আমি অন্যকিছু দেখতে পেলাম যেটা আমায় কিছু লুকিয়েছে।
.
.
.
মন্দিরের রাস্তা ধরে হাঁটছি। আর্মেতাসও আমার পাশে পাশে হাঁটছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। এই মুহূর্তে ওকে ঠিক শূকরের মতোই লাগছে।
উত্তরে বেশ দারুণ বাতাস বইছে। তীব্র মাথা ঘুরোচ্ছে। কি ঘটে গেলো,এখনও বুঝতে পারছি না। তাজা বাতাসের জন্য বুক ভরে একটা শ্বাস নিতেই বমি করে ফেললাম।
মন্দিরের মাংসপঁচা গন্ধ টা এখানেও এসে পড়েছে..!!
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment