পেঁয়াজ


- ভাইজান,আজকে দুপুরের খাওনে কি রানমু?

- আপনি আমাকে ভাইজান ডাকতেছেন কেনো? আমি কি আপনার ভাইয়ের বয়সী? আপনার বয়স চল্লিশের উপরে আর আমার মাত্র তেইশ।

- ওই একটা ডাকলেই অইলো..

কথাগুলো বলার সময় মর্জিনা বেগমের ভাঙা দাঁতগুলোর ফাঁক দিয়ে থুতু ছিটকে মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো।

- যা ইচ্ছা রান্না করেন। আর পরবর্তীতে যেন আপনার মুখে ভাইজান ডাক না শুনি। মামা অথবা নাম ধরে ডাকবেন।

কথাগুলো রাগের স্বরে বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন সিদ্দিকুর রহিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। পঠ্য বিষয়-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এছাড়াও তার আগ্রহ আছে অশরীরী জগত নিয়ে।

পরেরদিন আবারও মর্জিনা বেগমের সেই একই প্রশ্ন,ভাইজান,আজকে দুপুরের খাওনে কি রানমু?

সিদ্দিকুর রহিম বোধহয় পাগল হয়ে যাবেন। এই মহিলার মাথায় কি সমস্যা আছে? ছেলের বয়সী একটা পুরুষকে ভাইজান ডাকে কোন হিসেবে? নাহ,কাজের বুয়া বোধহয় এইবার পাল্টাতেই হবে।

শহরাঞ্চলে কাজের বুয়ার বড্ডো অভাব। তার উপর বেতন চওড়া। আকাল না পড়লে এই বুয়াকে কবেই বিদেয় করে দিতেন..!!

মর্জিনা বেগম একবেলাই আসে। দুপুরের খাবার রান্না করে দিয়ে চলে যায়। সিদ্দিকুর রহিম সেই খাবারের অর্ধেক দুপুরে,বাকী অর্ধেক রাতের বেলা নিজেই গরম করে খান। একটু বেশি কথা বললেও মহিলার রান্নার হাত খুবই চমৎকার,কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন তিনি।

আজ বড়ই ক্লান্তি লাগছে। প্রেজেন্টেশন ছিলো। সারাদিন এর পিছনেই খাটতে হয়েছে। আর এত কষ্ট করে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেই বা লাভ কি? ক্লাশে যে একটা সুন্দরী মেয়েও নেই। ইশ,যদি একটা পরী থাকতো..!! ছোটবেলায় কতো গল্প শুনেছেন-পরীরা নাকি সুন্দরী নারীদের চেয়েও অতি বেশি সুন্দরী,তাদের গায়ে নাকি এক টুকরো জামাও থাকেনা। আহা..!!

সিদ্দিকুর রহিমের এক মামা বলেছেন এসব কথা। তার কাছে নাকি নিয়মিত এক পরী আসতো। এমন কালো লোকের কাছে পরী আসতো? সিদ্দিকুর রহিম এইদিক দিয়ে রাজপুত্র বলা চলে। তিনি আরও শুনেছেন পরীরা নাকি ফর্সা ছেলেদের পছন্দ করে বেশি। তাহলে তার কাছে আজও কেনো একটা পরীও ধরা দিলোনা? একরাশ হতাশা নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি।

মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো সিদ্দিকুর রহিমের। খাটের বামদিকের জানালাটা খোলা। হুরহুর করে সেখান দিয়ে দখিনা বাতাস ঢুকছে। চাঁদের আলো সরাসরি তার খাটে পড়ছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। চাঁদের তীব্র আলোতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছে।

কিন্তু যতদূর মনে পড়ে,জানালা বন্ধ করেই তিনি ঘুমিয়েছিলেন। তাহলে খুললো কিভাবে? ডানদিকে কাত হতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কে যেন বসে আছে খাটের পাশে। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতেই সিদ্দিকুর রহিম বুঝতে পারলেন,এ যে একটা মেয়ে..!!

দরজার ছিটকিনি বন্ধ,তা ছাড়া এটা তিনতলার একটা রুম। এখানে জানালা দিয়ে মেয়ে ঢুকবে কিভাবে? আতংকিত অবস্থায় সিদ্দিকুর রহিম জিজ্ঞেস করলেন,
- কে,কে আপনি?

মেয়েটা মুখ তুলে চাইলো। সিদ্দিকুর রহিম উপলব্ধি করলেন,এতো সুন্দর মেয়ে বোধহয় তার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। অতি সুন্দর একটা মুখ,ঘনকালো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। ছিপছিপে দুধসাদা নগ্ন দেহের দিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে তিনি তাকিয়েই আছেন। তার দিকে তাকিয়েই মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো।

এতক্ষণে সিদ্দিকুর রহিম ধারণা করতে পারলেন,এ পরী না হয়েই যায় না..!!

মেয়েটি আস্তে আস্তে তার দিকে সরে আসছে। সিদ্দিকুর রহিমের দেহে রক্তের গরম স্রোত খেলে গেলো। নিজের অজান্তেই তেইশ বছরের ক্ষুধা যেনো জেগে উঠলো। পরীর মুখ তার মুখের কাছে আসতে থাকলো। ঠোঁটে ঠোঁট লাগার পূর্বমুহূর্তে সিদ্দিকুর রহিম হঠাৎ টের পেলেন,পরীর মুখ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ আসছে। আশ্চর্য ব্যাপার..!!

কে জানে,হয়তো পরীদের মুখ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ বের হওয়াই নিয়ম,হয়তো কেউ ই জানেনা এ কথাটা। সে যাকগে,ব্যাক্তিগতভাবে পেঁয়াজের গন্ধ অপছন্দ করলেও এই মুহূর্তে তা কিছুই নয়। বরং জৈবিক চাহিদায় অতি সুন্দরীর মুখে পেঁয়াজের গন্ধই শ্রেষ্ঠ।

ততক্ষণে দুজন দুজনকে জাপ্টে ধরেছে। দলাই-মলাই চরম মাত্রায় পৌঁছেও গিয়েছে। সিদ্দিকুর রহিম বুঝতে পারলেন,এই অতি সুন্দরী তার স্বপ্ন পূরণ করতেই যেন এসেছে। ধীরে ধীরে তার সমস্ত যৌবনশক্তি যেন শুষে নিচ্ছে..!!
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই সিদ্দিকুর রহিমের গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো। বেশ ভালো একটা স্বপ্ন দেখা হয়েছে গতকাল।

কিন্তু এ কি,তার গায়ে যে কোনো কাপড় নেই..!! বামদিকে তাকাতেই দেখা গেলো জানালা খোলা। কিন্তু কাল তো কপাট লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। বিছানার দিকে তাকাতেই অবাক হওয়ার পালা। এখানে ওখানে মেয়েমানুষের মাথার বড় বড় চুল ছড়িয়ে আছে।

তাহলে কি স্বপ্ন ছিলোনা গতকাল রাতের ঘটনা...??

দরজায় টোকা পড়তেই তাড়াতাড়ি জামা পড়ে দরজা খুলে দিলেন। মর্জিনা বেগম এসেছে। দরজা খুলে দিয়েই ফের বিছানায় বসে পড়লেন তিনি। সিদ্দিকুর রহিমের মাথা ঘুরছে। সত্যিই কি তাহলে পরীর অস্তিত্ব আছে?

অবশ্যই আছে। এই যে তার প্রমাণ। খোলা জানালা,একটু আগের বস্ত্রহীন দেহ,খাটে মেয়েমানুষের চুল। প্রথমে ব্যাপারটা মেনে নিতে না পারলেও সিদ্দিকুর রহিমের মুখে এখন অস্বাভাবিক খুশির হাসি। এক আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে।

মর্জিনা বেগম সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রতিদিনের মত একই প্রশ্ন,ভাইজান,আজকে দুপুরের খাওনে কি রানমু?
সিদ্দিকুর রহিম মুখ তুলে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকালেন। তাকিয়ে দেখলেন,মর্জিনা বেগম মিটমিট করে হাসছে।
মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো তার। তিনতলা থেকে এই মহিলাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে এখন।

আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। বেঢপ আকৃতির চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলা,যার ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ছিটকে দুনিয়া ভেসে যায়,সে কিনা সিদ্দিকুর রহিমকে ভাইজান বলে? এই বেটি কি জানে,সিদ্দিকুর রহিম কে? তার কত ক্ষমতা? যার কাছে পরী এসে ধরনা দেয়,তাকে ভাইজান বলে এই কুৎসিত মহিলা,তাও কাজের বুয়া?

পরীকে বললে কত খাবার এনে দিবে..!! এইসব ফালতু বুয়া-টুয়ার কোনো দরকার নেই। সটান হয়ে মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি,বড় করে একটা ঝাড়ি দিবেন বলে।

মর্জিনা বেগম ঠিক তখনই বলে উঠলো,
- কি অইছে ভাইজান,খাড়াইলেন ক্যান? কি রানমু হেইডা কওয়ার জন্য খাড়াইতে অইবো না।

তখনও মিটমিটিয়ে হাসছে মর্জিনা বেগম।

ঝাড়ি দিতে গিয়েও থমকে গেলেন সিদ্দিকুর রহিম,আর ঝাড়ি দেয়া হলোনা। আতংকে পা জমে গিয়েছে,গলা কাঠ হয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড বিষ্ময়ে তিনি যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন। কারণ,

মর্জিনা বেগমের মুখ থেকে ভসভস করে পেঁয়াজের গন্ধ বেরুচ্ছে...!!

No comments:

Post a Comment