জলকন্যা


(১)
আসগর মেম্বার পুকুরের ঘাটে বসে আছেন। জলকন্যার আশায়।

আজ পূর্নিমার রাত। বানভাসি জ্যোছনায় ছেয়ে গিয়েছে মাঠ-ঘাট। গাছের পাতাগুলো যেন সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। পুকুরের পানিতে জ্যোছনার আলোয় সাদাকালো যে ছায়া-প্রতিচ্ছায়ার সৃষ্টি হচ্ছে সেদিকে আসগর মেম্বারের দৃষ্টি পড়ছেনা। ওনার দৃষ্টি শান-বাধানো ঘাটের পানিতে। আজ যে জলকন্যার ভেসে উঠার কথা।

আসগর মেম্বারের চোখে হঠাৎ পানিতে নড়াচড়ার উপস্থিতি ধরা পড়লো। ঘাটের পানিতে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। কিছু একটা উঠে আসছে। একটা অবয়ব,তরুণীর অবয়ব। হ্যাঁ,এক সুন্দরী তরুণী। সিক্ত দেহে ঘাটের সিঁড়িগুলো বেয়ে উঠে আসছে সে। তরুণীটি আসগর মেম্বারের সামনে এসে দাঁড়ালো। আসগর মেম্বার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তরুণীর মুখপানে। অতি নিষ্পাপ একটা মুখ। চাঁদের আলোয় মুখখানা ঠিক পরীর মত লাগছে। নাহ্,পরী না। পরীরা তো আসমানে থাকে। কিন্তু যেসব পরী জলে থাকে? জলপরী? জলপরীদের মুখ কি নিষ্পাপ থাকে? এ জলপরী নয়,জলকন্যা..!!

আসগর মেম্বার মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত এক মায়া অনুভব করলেন,নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে জলকন্যার গালে হাতটা ছোঁয়ালেন।
ভেজা গালে হাত রেখেও টের পেলেন মেয়েটা কাঁদছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ মেয়েটা কাঁদছে..!! আসগর মেম্বারের চোখের কোণেও পানি আটকে আছে। বের হতে পারছেনা। আসগর মেম্বার কাঁদতে চাচ্ছেন,পারছেন না। দু'বার চেস্টা করলেন। পারলেন না। 

(২)
- স্যার,ও স্যার..

আসগর মেম্বার ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তার চোখের কোণে পানি জমে আছে।
- কি অইছে? মাঝরাইতে ডাক পারোস ক্যান?

- চেয়ারম্যান সাবের ফোন।

হাত বাড়িয়ে মজিদের হাত থেকে ফোন নিলেন আসগর মেম্বার।
- সালাম চেয়ারম্যান সাব। এই মাঝরাইতে কি ব্যাপার?

- খবর তো ভালা না মিয়া। কর্ণফুলীত সবিরের লাশ পাওন গেছে। সামনে মেম্বার ইলিকশন। তোমারে নিয়া তো চিন্তায় আছি।

- আমারে এইবার ছাড়ান দ্যান চেয়ারম্যান সাব। তিরিশ বছর মেম্বারি করছি। আর কত..!! খুনাখুনি আর ভাল্লাগেনা। আমারে ছাড়ান দ্যান। সালাম।

ফোনটা কেটে দিলেন আসগর মেম্বার। তার মন একটু বেশিই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বাইরে বেশ জ্যোছনা হয়েছে। রাতপাখিদের উড়োউড়িও দেখা যাচ্ছে। টিনের চালে অজানা কোন পাখি যেন ডানা ঝাপটালো..

(৩)
দুপুরের রোদে খা খা করছে চারদিক। নীলাকাশ থেকে আগুনতর রোদ ছিটকে এসে পড়ছে যেন। মাটি ফেঁটে ফেঁটে এখানে-সেখানে হাঁ হয়ে আছে। আসগর মেম্বার পুকুরঘাটে এসে দাঁড়ালেন। কি শান্ত টলটলে পানি..!! দূরে কাঁঠাল গাছটার নিচে একটা কুকুর জিভ বের করে বসে বসে কাঁপছে। একটা কাক বোধহয় উড়ে গেলো গনগনে আকাশ চিড়ে। আসগর মেম্বার খেয়াল করতে পারলেন না। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন পুকুরের পানির দিকে। শান্ত টলটলে পানিতে শুধু বিশ-বাইশ বছর আগের স্মৃতিই ভাসছে যেন।
আসগর মেম্বারের চোখে সেদিন যেন গনগনে আগুন ঝরে পড়ছিলো। মরিয়মের চুলের মুঠি ধরে মাটিতে হ্যাঁচকা টানে ফেলে দিয়েছিলেন।

- ওই ছিনাল,বাচ্চা অইলো ক্যামনে? তরে ট্যাকা দেইনা?

মরিয়মের পেট বাড়িয়ে প্রচন্ড এক লাথি কষিয়েছিলেন সেদিন। সাতমাসের অনাগত প্রাণীটা রক্ত নিয়ে মেঝেতে উঁকি দিয়ে তড়পিয়েছিলো খানিকক্ষণ। সাথে সাথে প্রচন্ড চিৎকারে মরিয়ম জ্ঞান হারিয়েছিলো। সে জ্ঞান আর ফিরেনি।

অনাগত যে প্রাণীটা আগত হয়ে গিয়েছে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন আসগর মেম্বার। থানা-পুলিশের ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হতোনা। নিজের বউ এমনকি গ্রামবাসী এতদিন ধরে সবকিছু জানলেও প্রমাণ না রাখলেই পুলিশ টিকিটাও ধরতে পারবে না। অবৈধ সন্তানের মৃতদেহটা বস্তায় পুড়ে সাথে কিছু ইট বেঁধে নিজ পুকুরে ফেলে দিলেন তিনি,প্রমাণাদি খতম।

থানা-পুলিশ হলে ইলিকশনে সমস্যা হবে। তাই চেয়ারম্যান সাহেব মরিয়মের ঘটনাটা রক্তবমিতে নিয়ে গিয়ে পরপর দু'বার জিতে যাওয়া আসগর মেম্বারকে সে বারও দাঁড় করিয়ে দিলেন। ভোটে জিতে গেলেও নিজের ঘরের বউ আয়েশার ভোট পান নি। তালাক দিয়ে সে বাপের বাড়ি চলে গেলো।

পরপর ছয়বার কোন ভাগ্যগুনে মেম্বার হয়েছেন তা আজও বুঝেননি তিনি। বিয়ে থা'ও আর করেন নি।

হঠাৎ মজিদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন।
- স্যার,খাইতে চলেন। দুপুর অইয়া গেছে..

- আইতাছি,তুই যা।
ঘরে ফিরতে গিয়ে আবারও কি কারণে যেন পুকুরের পানিতে তাকালেন আসগর মেম্বার। 

(৪)
আসগর মেম্বার পুকুরঘাটে বসে আছেন। জলকন্যার আশায়।

চারদিকে মৃত্যুনিস্তব্ধতা। গাঢ় অন্ধকারে গাছের পাতা,পুকুরের পানি সব যেন মিশকালো হয়ে আছে।
হঠাৎ মেঘের পিছন হতে চাঁদ বেড়িয়ে এলো,জ্যোছনায় ছেয়ে গেলো আশেপাশের প্রান্তর। ঘাটের পানিতে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। কিছু একটা উঠে আসছে,একটা অবয়ব,তরুণীর অবয়ব। জলকন্যা..!!

জলকন্যার গায়ে বিয়ের লাল শাড়ি দেখতে পেলেন আসগর মেম্বার। মেয়েটা এসে তার সামনে দাঁড়ালো। আগের মতই নিষ্পাপিনীর গালে হাত রাখলেন। মেয়েটা কাঁদছে। তপ্ত চোখের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় আসগর মেম্বারের হাত বেয়ে পড়তে লাগলো। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বলে উঠলো,

- আব্বা..!! আমারে বিয়ার শাড়ীতে কেমন লাগতাছে?

- আমারে বাপ কইস না মা। আমি বাপের যোগ্য না।

- বস্তায় পুইরা পানিত ফালায়া দিছো বইলা তোমারে বাপ কমু না বুঝি? কি কও আব্বা..!! তুমি না আমারে জন্ম দিছো? দেহো আব্বা দেহো,আমি বিয়ার শাড়ি পড়ছি। আমারে কেমন লাগতাছে আব্বা?

- অনেক সুন্দর রে মা। সেইদিন যদি তরে মাইরা না ফালায়া দিতাম,তাইলে আইজ তুই এইরহম শাড়ী পইড়া শ্বশুরবাড়ি যাইতি। তুই নিষ্পাপরে মা আমি ঘরে না তুইলা পানিত ফালাইছি। আমারে মাপ কইরা দে রে মা,মাপ কইরা দে..ঘরে চল..

- ছিহ্ আব্বা,কি কও? তুমি তো আমার বাপ। অবৈধ সন্তানগো বাপ থাকে,ঘর-পরিচয় থাকতে অয় না। বিশ বছর আগে এইখানে ফালায় দিছো,আমি এই পানিতে খুব ভালা আছি আব্বা। ঘরে যামু ক্যামনে? আমি না জলকইন্যা? যাই আব্বা?

- যাইস না মা,দোহাই লাগে,যাইস না..
হাত ছাড়িয়ে জলকন্যা ধীরে ধীরে ধোয়াশায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। আসগর মেম্বার হাত বাড়ালেন,কিছু ধরতে পারলেন না।

(৫)
ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন আসগর মেম্বার। এদিক-ওদিক তাকালেন। কিছুই চোখে পড়লোনা। ঘর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। চারদিক জ্যোছনায় ছেয়েছে। রাতপাখিরা আকাশে উড়োউড়ি করছে।

উদভ্রান্তের মত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন আসগর মেম্বার। দৌড়োচ্ছেন তিনি। উর্ধ্বশ্বাসে। পুকুরঘাটে এসে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। শান্ত টলটলে পানির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,

"অ মা,যাইস না। দোহাই লাগে রে মা,আমার কাছে আয়। আমারে মাপ কইরা দে রে মা,দোহাই লাগে,যাইস না..."

No comments:

Post a Comment