লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো দার্জিলিংয়ে। গ্রীষ্মের ছুটিতে শীতের ঝাপটা খেতে সোজা চলে গিয়েছিলাম খালার বাসায়। খালার বাড়ি দার্জিলিংয়ের কুর্সেং এ। খালাতো বোনই লোকটার কথা বলেছিলো। বিশাল বড় সন্ন্যাসী নাকি। আত্মা খেতে পারে। রীতিমতো হো হো করে হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম সেদিন।
- তা মুসকান, আত্মা খাওয়ার পদ্ধতিটা কি রকম তোর সন্ন্যাসী বাবার?
- সন্নাসী আবার আমার বাবা হলো কিভাবে? ভদ্রলোক জীবজন্তু কাঁচা খেয়ে ফেলে, ওভাবেই নাকি সাথে সাথে আত্মাও ভক্ষণ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মৃত মানুষের মাংসও খায়।
- কি বলিস..!! এ তো পুরোপুরি জংলী টাইপের কাজ। আবার বলছিস ভদ্রলোক। নেংটি পড়ে ঘুরে বেড়ায় না?
- যাও তো, কি সব বলো না তুমি..!! পুরোদস্তুর ভদ্রলোক ব্যাটা। অনেক ক্ষমতা।
- যেমন?
- উনি নিজের বুকে শূল বিধিয়েও বেঁচে থাকতে পারেন।
- এ আর এমন কি। কোনো কৌশল আয়ত্ত করেছে হয়তো।
- শুধু তাই না, উনি মুখের রূপও বদলাতে পারেন, দেহের কোনো অংশ কেঁটে গেলে রক্তপাত হয় না ওনার। বিশ্বাস না হলে তুমি চলো, দেখবে।
কিছুটা আকর্ষণ বোধ করায় রাজি হয়ে গেলাম আমি।
- কোথায় আস্তানা ব্যাটার?
- ডাউন হিলে।
সেদিন সন্ধ্যায় মুসকান ডাউনহিলে নিয়ে গেলো আমায়। অরণ্যের মধ্যে চা বাগান, তার মধ্য দিয়ে বৃস্টিতে ভিজে থাকা রাস্তা। বিকেলে বেড়িয়েছি। সন্ধ্যা যেন টুপ করে নামলো। অন্ধকারে সন্নাসীর বাড়ি খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো। তার উপর সাথে রয়েছে সুন্দরী খালাতো বোন। মেয়েটার সাহস আছে বলতে হবে।
জনমানবহীন একটা কুটির ঠিক জঙ্গলের মাঝখানে। চেঁচিয়ে হ্যালো বলতেই পান্জাবী পাজামা পড়া একজন লোক বের হয়ে আসলো। ক্লিন শেভ, আর্মি কাটিং চুল, ফর্সা গায়ের রং, বয়স ত্রিশের মত হবে। বিশ্বাসই ই হতে চায় না এ লোক নাকি এত উদ্ভট কান্ডের উৎস। শিওর হয়ে গেলাম, যা যা শুনেছি সবই ভাওতাবাজি।
একগাল হাসি দিয়ে লোকটা ঘরে নিয়ে গেলো আমাদের। আমাদের খাটে বসিয়ে নিজে মেঝেতে বসলো। মুসকান আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো তার সাথে। লোকটার নাম ত্রিভুবন রায়।
- শুনলাম, আপনি নাকি জীবজন্তু কাঁচা খান? মানুষের মাংসও নাকি খান?
“আগে খেতাম। এখন না।”, শীতল গলায় ত্রিভুবন উত্তর দিলো।
- আপনার তো মনে হয় মানসিক রোগ আছে। নাহলে মৃত মানুষের মাংসও কেউ খায়? কুরু ও স্ক্রেপী রোগীরা মনোরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এসব করে।
- আমি মানসিক রোগে আক্রান্ত নই জনাব। এটা সাধনার ফল।
- তা কোথায় এই জঘন্য সাধনা করেছেন শুনি?
- মণিকর্নিকায়।
মণিকর্নিকা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে আমার। ভারতের সবচেয়ে খোলামেলা শশ্মান। কাশীতে অবস্থিত। অঘোরী সাধুরা চিতা থেকে মাংস তুলে খায়। অর্ধদগ্ধ মৃতদেহও তুলে আনে গঙ্গা থেকে। প্রথমে কুকুর, বিড়াল, কাক ইত্যাদির মাংস কাঁচা খায় তারপর আস্তে আস্তে মানুষের দিকে ঝুঁকতে থাকে।
- আপনি হঠাৎ এই কর্মে ঢুকলেন কেনো?
- সে অনেক ইতিহাস জনাব। সংক্ষেপে বলি। হার্ভার্ডে মনোবিদ্যার উপর পড়াশোনা করে বছর পাঁচেক আগে ছিলাম অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। জানেনই তো, সম্মোহন বিদ্যার শহর। গুরু ছিলেন ড. রবার্তো এ্যান্টন। মেজমেরিজমে রীতিমতো রাজা হয়ে উঠেছিলেন। ঠিক করলেন, এমন কিছু করবেন যা সবকিছু কাঁপিয়ে দিবে। মানব আত্মাকে আয়ত্বে আনার কৌশল। শুরু হলো একের পর এক পরীক্ষা। প্রথমে সম্মোহন তারপর তার আত্মাকে বের করে এনে নিজের আয়ত্বে রাখা। সম্মোহনের সময়ই পরপর দুজন মানুষ মারা গেলো। ভিয়েনার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট গরাদে পুরলো স্যারকে। মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। শিষ্য হিসেবে সবটুকু জ্ঞানই পেয়েছিলাম স্যারের কাছে। পালিয়ে এলাম নিজের দেশ, ইন্ডিয়ায়। ঠিক করলাম স্যারের পরীক্ষা আমি সম্পন্ন করবো।
- তা মশাই, পরীক্ষার অগ্রগতি কদ্দুর?
- এখনও পরিপূর্ণ হয় নি।
আমি টিপ্পনি কেঁটে বললাম, “আপনার প্রসেসিংটাও আমার কাছে পরিপূর্ণ ব্যাখায়িত হয়নি। সম্মোহন করে আত্মা দেহ থেকে বের করে নিয়ে আসার সাথে মানুষের মাংস খাওয়ার কি সম্পর্ক?”
ত্রিভুবন রায় মেঝেতে জাঁকিয়ে বসলেন। বললেন,
- দাঁড়ান, আপনাকে বুঝাই। জানেন কি, বাইবেলে যাকোব ২:২৬ এ লেখা আছে, আত্মাবিহীন দেহ মৃত। আত্মা হলো দেহকে সজীবতা দানকারী শক্তি যা ফুসফুসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। কোনো কারণে কারো শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুক্ষণ বন্ধ থাকলে তার চেতনা ফিরিয়ে আনলে সে বেঁচে যায়। কারণ, জীবনের স্ফুলিংগ তখনও কোষগুলোতে বর্তমান থাকে। সম্মোহন করে কারো শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে তার দেহকোষ গুলোকে খেতে পারলে সেই দেহের আত্মা তখন ভক্ষণকারীর দেহে ঢুকতে থাকে, ভক্ষণকারীর প্রাণশক্তি বাড়তে থাকে। সে প্রচন্ড ক্ষমতার অধিকারী হতে থাকে।
আমি হো হো করে হেসে বললাম,
- বেশ মজার বলেছেন মশাই। যাই হোক, মড়াখেকো মানুষ আপনি। মড়া খেয়েছেন যাতে মানবমাংস খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়। কিন্তু শেষ ধাপ মানে কারো আত্মাকে খেয়েছেন কি?
- না, কারণ কোনো জীবিত মানুষ পাইনি পরীক্ষার জন্য।
আমি আবার হেসে বললাম, “নিন, আমার ছোট বোনটাকে নিন। পরীক্ষা করুন।”
মুসকান চিৎকার করে উঠলো, “এসব কি বলছো ভাইয়া?”
- ধুর পাগলী, সব ভাওতাবাজি। ত্রিভুবন বাবু, দেখান আপনার পরীক্ষার ফল।
লোকটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। যেন হাজার বছরের সাধনা করে একটা সুযোগ পেয়েছে। মুসকান কিছু বলার আগেই ত্রিভুবন রায় তুড়ি মেরে ওকে সম্মোহিত করে ফেললো। টান দিয়ে গায়ের জামা ছিড়ে হৃৎপিণ্ডের দিকের মাংস কামড়িয়ে খেতে শুরু করলো। তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটা সত্যিই তীব্র সুন্দরী। মুসকানের শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ কিন্তু হৃৎপিণ্ড সচল। ক্ষুধার্ত বাঘের মত মাংস খাচ্ছে ত্রিভুবন। ঘরের মেঝেতে রক্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বেড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। থিওরি অনুযায়ী মুসকানের আত্মা ত্রিভুবনের দেহে ঢুকাতে হলে পুরো শরীরটা খেয়ে শেষ করতে হবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
অন্ধকারে জোর কদমে হাঁটছি পাহাড়ী রাস্তায়। কলমটা ধরার জন্য হাতটা নিশপিশ করছে। অভিজ্ঞতাটা গল্পে রূপ দিতে হবে। কারণ, লেখক হলেও ত্রিভুবনের মত আমিও সাইকো।
প্রকাশিত হয়েছিল- নবদিবাকর পত্রিকায়
No comments:
Post a Comment