হ্যাংলা দা


- কখনো মড়া পুড়িয়েছিস,নিতাই?

- মড়া? ঢের পুড়িয়েছি। এই গেল হপ্তায় ই তো নিবারণ কাকুর মড়া পোড়ালাম।

সুদেব যেন একটা ধাক্কা খেলো। ভারী একটা অবাক চোখে নিতাইর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কি বলিস? কিভাবে?

- আর বলিস না। অম্বল হয়েছিলো। বেচারা সারাজীবন অন্যকে অম্বলের অষুধ দিয়ে শেষমেষ কিনা নিজেই মরে গেলো,আহারে..!!

- তবে হ্যাংলা দা যে আমায় কিচ্ছুটি বললোনা?

এবার নিতাই যেন একটা ধাক্কা খেলো। ভারী অবাক চোখে সুদেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
- হ্যাংলা দা? কোথায় পেলি তাকে?

- কেনো? সে ই তো আমাকে নদী পার করে দিলো। হ্যাংলা দা না থাকলে এই শীতের রাত্তিরে নৌকো যে কোথায় পেতাম,ভেবেই দায়।

নিতাই যেন কথাটা বিশ্বাস করলো না। ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- তুই সত্যি বলছিস তো সুদেব?

- ভারী আজিব..!! মিথ্যে বলতে যাবো কোন সঙে? হ্যাংলা দা এর মত ভালো ছেলে এই তল্লাটে দ্বিতীয়টা আছে নাকি যে মিথ্যে বলতে যাবো?

নিতাই হাত বাড়িয়ে বললো,
- তবে আমায় ছুঁয়ে বল?

সুদেব একটু বিরক্তির সাথে নিতাইর হাত ছুঁয়ে বললো,
- হারামজাদা,এই নে,তোর হাত ছুঁয়েই বলছি।

নিতাই হাঁটার মাঝেই থমকে দাঁড়ালো।

- কি রে,থামলি কেনো? কত দূর পথ বাকি। ভাগ্যিস মাঝপথে তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। নইলে এই নিশি রাত্তিরে একা একা পথ যেতে ভীষণ বাজে লাগতো। যদিও হ্যাংলা দা কে বলেছিলাম,বাড়ি পর্যন্ত আমার সাথেই যেতে। বললো,তার নাকি বাজারে কি সব কাজ আছে।

নিতাই শান্ত স্বরে বললো,
- সুদেব,চুপ কর। হ্যাংলা দা দিন পনেরো আগে মারা গেছে।

সুদেব খানিকক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে উঠলো।
- ঢপ মারছিস হারামজাদা..!! হ্যাংলা দা মরে গেলে আমায় নদী পার করে দিলো কে? তোর শ্বশুরমশাই?

- আমি কিন্তু সত্যি বলছি সুদেব।

- ধুর,ঢপ মারছিস। আচ্ছা,গা ছুঁয়ে বল দেখি?

নিতাই সুদেবের গা ছুঁয়ে বললো,
- সত্যি বলছি। গত মাসের শেষের দিকে ট্রেনে কাটা পড়ে মরে গেলো। আমি নিজে কালীঘাটের চিতায় উঠিয়েছি।
সুদেবের মাথাটা ঝিঁ ঝিঁ করছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো দরকার।
.
.
.
সুদেব শুয়ে আছে। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বোধহয় জ্বর আসছে। ভয়ে নাকি নদীর ঠান্ডা হাওয়ায়,ধরা যাচ্ছেনা। তবে ঠান্ডা হাওয়ার জন্যই হবার সম্ভাবনা বেশি। হ্যাংলা দা'র ঘটনা জানার পর বিষম খেলেও ততটা ভয় পায়নি। ছোটবেলা থেকেই সুদেব কিছুটা সাহসী।

ঠাকুর'দা একবার বলেছিলেন,"সুদেব নামটাই পূণ্য। নামের মধ্যে একটা দেবতা দেবতা ভাব আছে। আমার নাতিকে কোনো শয়তান ভয় দেখাতে আসলে মুন্ডি কেটে রেখে দেবে।"

যদিও সুদেব বয়স পাঁচেক সময় হিজলতলায় হামা ভূতের চড় খেয়েছিলো। চড় খাওয়ার পরপরই হিজলতলার সব গাছ কেটে ফেলা হলো। বাবু বংশের ছেলের গালে চড়? ভূতদের গুষ্টিই উঠিয়ে দেবো ক্ষণ..!!

সুদেব অনেক চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছেনা। শুয়ে শুয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগলো শুধু। ডানদিকে চোখ পড়তেই চোখ কুঁচকিয়ে ফেললো। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। আবছা আলোতে বেশখানেক সময় তাকিয়ে থাকার পর বুঝলো,কে যেনো পড়ার টেবিলের চেয়ারটা ঘরের মাঝে এনে তাতে বসে আছে।

অবয়বটা উঠে দাঁড়ালো। হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোতে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে,একটা ছেলে। ছ'ফুটখানেক লম্বা,টিঙটিঙে শরীর,অন্ধকারের কালো রংয়ের মাঝে অবয়বটা আরও গাঢ় কালো হয়ে আছে। কালো শরীরে ধূসর রংয়ের ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ভারী ঢিলেঢালা একটা গেন্জি পরনে।

অবয়বটা ঠায় চেয়ার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে। সুদেব বিছানায় উঠে বসতে বসতে যেন অবয়বটাকে খানিকটা চিনতে পারলো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,"হ্যাংলা দা?"

বলতে বলতেই ধপ করে ফের বিছানায় পড়ে গেলো সে।
.
.
.
নিতাই খেতে খেতে ছ্যাঁক করে উঠলো।
- দেখ দেখ সুদেব,পড়লো তো পড়লো,আমার মুখেই পিত্তি টা পড়লো..!!

সুদেব চুপচাপ খেয়ে চলেছে। গায়ের জ্বর ভীষণ বেড়েছে। মা বলেছিলো,ঘর থেকে বেরোতে না। কিন্তু সুদেবেরও আবার ঘরে মন টেকে না। পাছে নিতাই,ভাজা ইলিশের নেমন্তন দিলো।

- বুঝলি সুদেব,মাছের পিত্তি মুখে পড়লেই মুখটা বেস্বাদ হয়ে যায় রে। মানুষের পিন্ডিরও একই কাহিনী। সেদিন কি হয়েছিলো জানিস? হ্যাংলা দা'র মড়া পোড়াচ্ছি,হঠাৎ করে কি যেন 'টাস্' করে উঠলো। দেখি আমার মুখে ছিটছিটে পোড়া মাংসের টুকরো। আমি তো যা ভয় পেলাম..!! অম্বিকা কাকু বললো,ভয় পাসনে,ওটা পিন্ডি ফেটেছে।

নিতাই হো হো করে হাসছে। সুদেব খাওয়া বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। হাত ধুতে কলপাড়ে যেতে হবে। শরীরটা বেজায় ভার লাগছে।

কল চেপে হাত ধুতে ধুতে যেই-ই সুদেব ঘাড় উঠিয়েছে,দেখে হ্যাংলা দা দাঁড়িয়ে। ছ'ফুটখানেক লম্বা,টিঙটিঙে শরীর,মিশকালো গায়ের রং। কালো শরীরে ধূসর রংয়ের ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ভারী ঢিলেঢালা একটা গেন্জি পরনে।

সুদেবের চোখের পলক পড়ছেনা,বোধহয় দৃষ্টিভ্রম। হ্যাংলা দা বলে উঠলো,
- জানিস রে সুদিব? ঝুড়িবোঝাই করে ইলিশ মাছ নিয়ে যাচ্চিলাম বাজারে,হঠাত করি রেলে পা আটকে গেলো। কত তড়পালাম,ছাড়লোই না..!! পিছ ফিরতেই দেখি ট্রেনমামা ঘটঘট করি চলে গেলো উপর দিয়ে।

সুদেবের গা শিরশির করে উঠলো। হ্যাংলা দা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সুদেব চোখ ডললো। দৃষ্টিভ্রম গেলো না। হ্যাংলা দা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জ্বর বোধহয় বেশ বেড়েছে। চোখের ধাঁধা তাই গেড়ে বসেছে।

সুদেব উঠে দাঁড়ালো পেছন ঘুরে। বাড়ি গিয়ে একটা কষে ঘুম দিতে হবে। পেছন থেকে হ্যাংলা দা যেন বলে উঠলো,
- আমি ইলিশ মাছ নিয়ে ট্রেনে কাটা পড়লাম,আর তুই আমায় দেখে সেই ইলিশ খেতে পারলি না। সুদিব রে,ইলিশ আর খাস নে। তুই না আমায় কত ভালো পেতি?
.
.
.
নিতাই সুদেবকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
- এত কষ্ট করে বৌদিকে দিয়ে তোর জন্য মাছ ভাজালাম,তুই তো একটাও খেতে পারলি না। জ্বর কি খুব বেশি?
সুদেব গোঁ করে উঠলো,

- হুম।

- আচ্ছা সুদেব,বলতো দেখি,ইলিশ মাছের গায়ের রং এমনতর হয় কেন?

সুদেব বললো,জানিনা।

নিতাই কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
- কাউকে বলিস না। হ্যাংলা দা বলেছিলো। আমরা দশমীতে যেই দুর্গাকে ভাসিয়ে দিই,অমনি ইলিশেরা সেইদিন ঝাঁক বেঁধে মায়ের মাটি খায়,অলংকার খায়। তাই নাকি ইলিশের রং এত খোলতা হয়..!!

সুদেবের মাথায় কিছু ঢুকছেনা। হাজার হাজার মাছি যেন মাথার ভেতর ভনভন করে ঘুরছে।
.
.
.
ঘুম ভাঙতেই সুদেব উঠে বসলো। শরীরটা এখন একটু হালকা লাগছে। তিন বছর পর বাড়ি এসে নিজের ঘরটাকেও ভালমত দেখা হয় নি। মা এসে চালভাজা দিয়ে গেলো।

- বাপধন,যা জ্বর বাঁধিয়েচিস..!! চালভাজায় পেঁয়াজ মরিচ দিয়েচি। চাবা বসে বসে,স্বাদ জুটবে।
সুদেব মাথা নেড়ে চালভাজার দিকে হাত বাড়াতেই দেখে,সামনে বসে হ্যাংলা দা দিব্যি চালভাজা চিবোচ্ছে।

- বুঝলি রে সুদিব,মরে যাওয়ার পর কিচ্ছুটি খেতে পারি নে। সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। এই দেখ,তোর মনে হচ্ছে চাল চিবোচ্ছি,আসলে কিন্তু চিবোচ্ছি না। হো হো..

সুদেবের ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দেয়। কিন্তু তা করা সম্ভব হচ্ছে না কেন যেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
- তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেনো,হ্যাংলা দা?

- সে কি রে..!! তুই না আমার জাতভাই? তোর কাছে আসবো না তো কি নিতাইর কাছে যাবো?

- তুমি না মরে গেছো? দুনিয়াতে থেকে আর কাজ কি?

- স্বাদে কি আর থাকি রে? নিবারণ কাকু মরলো,তিনকূলে কেউ ছিলো না। কবিরাজ বলে সায়েবের লোকেরা মস্ত বড় ভুজ্যি দিলো। সায়েবের ছেলে মুখাগ্নি দিলো। বলি আমার থেকেই তো সব ইলিশ নিতি,দামও দিতি না ঠিক করে। আমারও তো তিনকূলে কেউ নেই। ওরা কি পারতো না আমার নামে একটা ভুজ্যি দিতে? গাঁয়ের লোকের কম উপকার করেছি আমি? ঘর পাহাড়া,খেত নিড়ানো,গরু ধরে দেয়া,কম কাজ করেছি? শালা শুয়োরের দল।

সুদেব ঘোঁৎ করে উঠলো।
- ভুজ্যি না দিলে স্বর্গে যাওয়া যায় না বুঝি?

- সে তো জানি নে। তবে আমায় যে যেতে দিচ্ছে না।

সুদেবের মনে হচ্ছে,তার মাথাটা গেছে। নাহলে চোখের সামনে মরে যাওয়া মানুষ জমিয়ে আড্ডা দেয় কিভাবে..!!
.
.
.
দিন চারেক পেরিয়ে গেলো। সুদেব উঠতে বসতে হ্যাংলা দা কে দেখতে পায়। হয়তো মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে চোখ মেলে তাকিয়েছে,দেখা গেলো হ্যাংলা দা মশারির উপর শুয়ে আছে নয়তো কড়িকাঠ ধরে ঝুলে আছে। ভোরবেলা কলপাড়ে গিয়ে দেখা গেলো,সে আগে থেকেই কয়লা তুলে দাঁত মাজছে।

- ভূতদের আবার দাঁত মাজা লাগে নাকি,হ্যাংলা দা?

- শখের বশে মাজি আর কি। দেখতো,এই দাঁতটা পরিষ্কার হয়েছে কি না?

এই বলে হাত দিয়ে একটা দাঁত খুলে সুদেবের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

সুদেব বুঝতে পারছে না কি করবে। হ্যাংলা দা পিছু ছাড়ছে না। মরে যাওয়া মানুষ পিছু পিছু ঘুরলে নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। হাজার হলেও সুদেব শহরে থাকে,বাস্তবতা আছে একটা।
.
.
.
সেদিন মাঠে বসে সুদেব প্রক্ষালন সারছে,পাশে তাকিয়ে দেখে হ্যাংলা দা-ও সেভাবেই বসে আছে। সুদেব ফিক করে হেসে বললো,
- ভুতরা শুধু খেতে পারে জানতাম,হাগতেও পারে,জানতাম না তো হ্যাংলা দা।

হ্যাংলা দা নদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
- সুদিব,ভুতরা সব পারে। আর আমি তো সেই ধরনের ভুত না। ভুজ্যির জন্য শুধু আটকে আছি।

- তুমি তো পুরো খাসা জিনিস..!! ভুজ্যি ছাড়া চলে যাওনা ওপারে,সমস্যা কি?

- না রে সুদিব,যাবো না রে। দে না সুদিব,দে না? আমার নামে একটা ভুজ্যিই তো। আমিও স্বর্গে যেতে পারি তাহলে।
সুদেব উঠে দাঁড়ালো। কম্ম সাবাড় হয়েছে।
.
.
.
নিতাই চোখ কপালে তুলে বললো,
- কি রে সুদেব,একদম সুস্থ মনে হচ্ছে? যা জ্বরে পড়েছিলি,ভাবলাম একমাসের আগে তো উঠতেই পারবি না।

- বাদ দে ওসব। চল আমার সাথে।

- কোথায় যাবো?

- বামুন ঠাকুরের বাড়ি।

- কেনো রে? পূজা লেগেছে নাকি তোর বাড়ি?

সুদেব উত্তর দিলো,
- আরে না। গায়ে একটা ভুজ্যি উচ্ছুগ্গু না দিলে চলে কেমন করে? শালা নামেও হ্যাংলা,কাজেও হ্যাংলা..!!

No comments:

Post a Comment