মরইণ্যা


- অ মইনুদ্দী,হুনছোত নি? খোকন চোরায় ত পা ভাঙছে..

- কি কও? ক্যামনে?

খানিকক্ষণ হো হো করে হেসে দম ফেললেন মকবুল মিয়া। ফিক ফিক করে হাসতে হাসতেই বললেন,
- আর ক্যামনে? ইউসুপের কব্বরের ধারে যেই খেজুর গাছ আছিলো,হেইডাত রস চুরি করতে উঠছিলো মাইজ রাইতে। রস নামানের সময় কব্বর থেইকা ইউসুপ কয়,ক্যাডায়,ক্যাডায় গাছে? আর যায় কই..!! ডর খাইয়া খোকইন্যা ধিড়িম কইরা নিচে পড়ছে।

আবারো তারস্বরে হো হো করে হেসে উঠলেন মকবুল মিয়া। সাথে মইনুদ্দীর ফোকলা দাঁতও বেরিয়ে পড়লো। দু'জন একসাথে হেসেই চলেছেন। দোকানদার রামলাল যারপরনাই বিরক্ত। কবর থেকে ইউসুফ ব্যাপারী কথা বলেছেন,সেই ভয়ে একটা মানুষের পা ভেঙ্গেছে,এতে হাসার কি আছে?
.
.
.
ইউসুফ ব্যাপারী,ধলপুরের প্রতাপশালী ব্যক্তি। প্রতাপের জোরে জায়গা দখল,লুট-পাট এমনকি খুন-খারাবি কোনো কিছুই বাদ যায়নি।

একদিন সন্ধ্যায় গাঙের ঘাট থেকে স্নান শেষে ফিরছিলো হরিমতি। ইউসুফ ব্যাপারী লোভী চোখে পথ আগলে দাঁড়ায় হরিমতির। গা বাঁচাতে সে পথের ধারে রাখা ইট টা ঠুকে দেয় ব্যাপারীর কপালে।

থানা থেকে দারোগা এসে ধরে নিয়ে গেলো হরিমতিকে। রায় যাবজ্জীবন। গ্রামের মানুষ হরিমতির পক্ষই নিয়েছিলো। ফাঁসি টা সেই সুবাদে এড়ানো গিয়েছিলো। ওদিকে ব্যাপারীর জানাযা পড়াবার মতও কেউ ছিলো না। ইমাম সাহেব আর খাদেমরা মিলে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করলেন,ব্যাপারীর বাগান-বাড়িতে।

ক'দিন পর থেকে ঘটনা শুরু। গ্রামের লোকজন বাগান-বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাতায়াতই ছেড়ে দিলো। ব্যাপারী নাকি তার কবরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে,নাচানাচি করে এমনকি কেউ কেউ কবরের উপর বসে বিড়িও ফুঁকতে দেখেছে তাকে।

"পাপী মাইনষের কব্বর,সবই আযাবের নমুনা।" রহিমা বেগমের নাতনীর কথার বেড়ে ফের প্রশ্ন,
- কব্বরের উপ্রে বইয়া বিড়ি খাওন আবার কেমন আযাব গো,দাদী?

- চুপ করতো ছেমড়ি,মাইয়া মাইনষের এত্তো জাইন্যা কাম কি?
.
.
.
মকবুল মিয়া পান চিবোতে চিবোতে চায়ের কাপ টা মুখে তুললেন।
- ধুরো লামলাল,তোমার খাছালতটাই গ্যালো না। আজকেও লিকার কম,চায়ের ত কোনো স্বাদই নাই।

- আগে পান চাবানি বন্ধ করেন। পান চাবানের সময় চা খাইলে চায়ের স্বাদ আবার পাইবেন কই?

মকবুল মিয়া আর কোনো কথা বললেন না। মইনুদ্দীর দিকে মুখ ফেরালেন।
- অ মইনুদ্দী,হুনছোত নি ঘটনা? ইউসুপের কব্বরে ত ফের আযাব ফিরছে।

- কি কও মিয়াসাব..!! ঘটনা কি?

- আর কইছ না,কাইলকা বিয়ানবেলা নাকি করিইম্যার ছোডো পোলায় আইতাছিলো বাগানবাড়ি দিয়া। দূর থেইক্যা দেহে ধোঁয়া উঠতাছে সামনে। কাছে ভিড়া দেহে,ইউসুপের কব্বরের গর্ত থেইক্যা ধোঁয়া উঠতাছে। পোলায় ত ঝাইড়া দৌঁড়,ঘরের সামনে পৌঁছাইয়াই ফিট খাই গেলো।

- আ রি মিয়াসাব,দশবছর পরে নি আবার আযাব শুরু হইলো?

- পাপের কি আর বয়স আছে রে? পাপীর পাপ,আছমার বাপ..!!
.
.
.
গফুর মোল্লা বেশ কয়েক বছর ধরেই এ পথে যাতায়াত করেন। ভূত-টূতে ভয় নেই তার। আজ পর্যন্ত ইউসুফ ব্যাপারীর কানাঘুষোর টিকিটাও দেখতে পান নি। তবে আজ কেনো জানি ভয় করছে। কবরের মাথার দিকে গর্তটা বেশ বড় হয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়,কে যেন ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কবরের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়ালেন গফুর মোল্লা। কবরের মাথার দিকে যে গর্তটা,তার পাশেই আগুন জ্বলছে। লাল,ছোট্ট একটা আগুনের কুন্ডলী লাফাচ্ছে যেন।

এ-ই তাহলে সেই,ব্যাপারীর খারাপ আত্মা। ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করলেন গফুর মোল্লা। খানিক বাদেই ঝেড়ে দৌঁড়।
.
.
.
- মইনুদ্দী রে,পাগলডারে দেখতাছি না মাসখানেক হইলো,গ্যাছে কই?

- কার কথা কন? মরইণ্যা?

- গেরামে পাগল আর আছে ডা ক্যাডায়,শুনি?

মকবুল মিয়ার এমন কথায় রামলাল মনে মনে বললো,"বুইড়া,তুমি কি সুস্থ আদমি নাকি? পান চিবানের সময় চা খাও,আবার চায়ের স্বাদও চাও।"

মইনুদ্দী শুধরালো,
- পাগল ছাগল মানুষ। কই যায়,কই থাকে,ক্যাডায় জানে..!! রামলালের ত আবার বিশাল ক্ষতি।

কথাটি বলেই হো হো করে হেসে উঠলো সে।

মরইণ্যা বাসা-বাড়ি থেকে খাবার ভিক্ষে করলেও দিনে দশটা বিড়ি নগদে রামলালের দোকান থেকে কিনতো।
রামলাল গম্ভীর স্বরে বললো,
- দোকান আমার মরইণ্যার বিড়ির নামে না,ভগবানের নামে চলে। ভগবানের কাছে ট্যাকাই মাটি,মাটিই ট্যাকা।
.
.
.
বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে,ইউসুফ ব্যাপারীর বাগান-বাড়ির সমস্যা চরমে উঠেছে। নিতান্ত বাধ্য না হলে পারতপক্ষে কেউ ওপথ মাড়ায়-ই না।

মকবুল মিয়ার আবার গল্পের খুব শখ। আজ ঠিক করেছেন ও-পথ দিয়ে বাসায় ফিরবেন। একবার পেরোতে পারলে বাজারে বেশ ঘটা করে বলতে পারবেন,ব্যাপারীর আত্মা তাকে ভয় দেখায়না,নিজেই ভয় পায়।

কবরের পাশ দিয়ে যেতেই গর্তটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। মনে হচ্ছে,কেউ যেন ভেতর থেকে তাকে দেখছে। মন প্রচন্ড বারণ করলেও একটু সাহস করে,হাঁটু গেড়ে,মাটিতে উপুর হয়ে যেই উঁকি দিবেন,অমনি কালো শীর্ণ একটা হাত খপ করে মকবুল মিয়ার হাত চেপে ধরলো।

"ও মা-গো..!!"- বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে রটে গেলো,"ব্যাপারী,মকবুল মিয়ার হাত চাইপা ধরছে।"
.
.
.
সপ্তাহখানেক জ্বর-ভোগের পর সুস্থ হয়ে আজ রাত্তিরের পান খেতে বাজারে এসেছেন মকবুল মিয়া। মইনুদ্দী পাশে নেই। একা একা রামলালের সাথে গপ-সপ করতে ভালো লাগেনা তার। রামলাল সচরাচর কথাও বলেনা তেমন।

পান চিবোনের মাঝসময়ে মইনুদ্দী হঠাৎ কোথা থেকে যেন দৌঁড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো।
- কি রে মইনুদ্দী,দৌঁড়াস ক্যান? কি হইছে?

মইনুদ্দী হাঁপাতে হাঁপাতেই উত্তর দিলো,
- মিয়াসাব,আইতাছিলাম বাগানবাড়ি দিয়া। দেহি ব্যাপারী কব্বরের উপর উইঠ্যা বিড়ি টানতাছে। আমারে কয়,ওই মইনুদ্দী,আয় বিড়ি খাইয়া যা।

- হয়তো ভুল দেখছোত।

- আরে না মিয়া,এহনও বিড়ি টানতাছে। বিশ্বাস না হইলে চলো আমার লগে?

"কি কস..!!"- বলেই মকবুল মিয়া ছুট লাগালেন। ইতোমধ্যে জনা-বিশেক লোকও জমে গেছে। তারাও পিছন পিছন ছুট লাগালো।
.
.
.
দৌঁড়োনোর সময় দূর থেকেই মকবুল মিয়া অন্ধকারে দেখতে পেলেন,একটা অবয়ব যেন কবরের উপর বসে বিড়ি ফুঁকছে। কাছে পৌঁছানোর পর দেখতে পেলেন,অবয়বটি তখনও কবরের উপর বসে বসে দিব্যি বিড়ি ফুঁকছে। ততক্ষণে বাদবাকি সবাই এসে পড়েছে।

মকবুল মিয়া ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবয়বটির উপর টর্চ ফেলতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
- কি রে মরইণ্যা? তুই এইহানে? গত দেড়মাস কই ছিলি?

মরইণ্যা এক হাসিতে সবগুলো হলুদ দাঁত বের করে উত্তর দিলো,

- ক্যান? যেইখানে বইসা আছি,এইখানেই ত ছিলাম..!!


No comments:

Post a Comment