মসজিদ থেকে ভেসে আসা তীব্র শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জাগলাম। সেহরির সময় হয়ে গিয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের যন্ত্রণাটাও বেড়েছে। এই গরমেও কেনো জানি না ঠান্ডা লাগছে। অনেক্ষণ চুপ করে বসে থেকে যখন ভাতের হাড়ির দিকে হাত বাড়ালাম,অনুভব করলাম,সেটা খালি। পাশে দু মুঠো মুড়ি পড়ে আছে পলিথিনে। হাত বাড়িয়ে পলিথিনটা আর পানির বোতলটা টেনে নিলাম নিজের দিকে।
আজ বেশ আগেভাগেই বাসা থেকে বের হয়েছি। যখন ফ্যাক্টরি তে পৌঁছলাম,তখন বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়ি চোখে পড়লো। একটু এগোতেই দেখি,বেদম মারামারি চলছে। শ্রমিকদের সাথে নাকি বেতন ও ঈদ ভাতা নিয়ে ঝামেলার কারণে ফ্যাক্টরি বন্ধ। তার মানে বেতনের আশাও শেষ। শূন্য পকেট,সামনে সংঘর্ষ,বেতনহীন সময় ও বাড়ি ফেরার স্বপ্ন। গ্যাস্ট্রিক আর পরিবারের স্বপ্নীল চাহুনির চিন্তায় ধপ করে বসে পড়লাম কংক্রীটের রাস্তায়।
গত দুই মাস ধরে খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে জমানো যা কিছু টাকা ছিলো,বাড়ি ফেরার ভাড়া রেখে বাবা মা আর ছুটকির জন্য কিছু টুকটাক জিনিস কিনলাম। ঈশাতের জন্য এক জোড়া কানের দুল কিনেছি। বাস স্টেশনে এসে টিকেট কিনে অপেক্ষা করছি। একটা লোক পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
-কই যাইবেন ভাই?
-সিলেট।
-ও...আইচ্ছা....
লোকটার সর্দি লেগেছে বুঝা যাচ্ছে। চোখও লাল। পকেট থেকে নাক মোছার জন্য লাল রুমালটা বের করে ঝাড়া দিয়ে ভাঁজ করলো। আমার আর কিছু মনে নেই।
.
.
.
মাগরিবের আজানে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি আমার সাথে কিছুই নেই। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। অনেক কস্টে পানি খেয়ে ইফতার করলাম। মাথাটা শূন্য লাগছে,চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। গত ৩বছর বাড়ি যেতে পারিনি কোনো না কোনো কারণে। খুব আশা ছিলো এবার বেশ ঘটা করে বাড়ি ফিরবো।
হলো না।
মহাসড়কে বেশ ভীড়। গাড়ি বোঝাই শুধু মানুষ আর মানুষ। কাল ঈদ। চোখে ঝাপসা দেখছি সব। মা বাবা ছুটকি আর ঈশাতের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। শরীরটা ভেঙ্গে আসছে। মায়ের মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। গ্রামের বাড়ি স্কুল মাঠ বাজার সব কিছু চোখে ভেসে উঠছে। স্রোতের মত মানুষ চোখের সামনে দিয়ে বাসায় ফিরছে। বুকটা ধ্বক্ করে উঠলো। সবাই যে বাসায় আমার জন্য আকুল দৃষ্টিতে বসে আছে।
আমায় বাড়ি ফিরতেই হবে। মাথায় কিচ্ছু নেই। যেভাবেই হোক,ফিরতেই হবে।
সিলেটগামী ট্রাকে চেপে বসলাম। শুধু অনুভব করছি,দ্রুত ঢাকা থেকে সরে যাচ্ছি। মাঝরাতে যখন ভাড়া চাইলো,ভাড়া দিতে না পাড়ায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার কথা বলেও নামায়নি। হয়তো ঈদ বলে,নয়তো শরীরের অবস্থা দেখে।
ভোর বেলা সিলেট এসে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে পারছিলাম না। চারদিকে ঈদের খুশি দেখে জোড় ফিরে পেয়েছি। আমার গ্রাম একটু ভিতরেই। টলতে টলতে হাঁটা দিলাম। যখন গাঁয়ে ফিরলাম,সবাই ঈদের নামাজ পড়ে ঘরে ফিরছে। ছোট চাচা ও আরো কয়েকজনের সাথে দেখা হয়ে গেলো। চিৎকার করে এসে জড়িয়ে ধরলো সবাই। আমার শরীরও হাল ছেড়ে দিলো।
যখন ঘুম ভাঙলো,চেয়ে দেখি মা কাঁদছে। বাবা মাথায় হাত বুলোচ্ছে। ছুটকী পায়ের কাছে বসে আছে। চাচা-চাচী পাশেই দাঁড়িয়ে। সবার চোখেই জল। আমার চোখ জ্বলছে। কাউকে খুঁজছি আমি,সেটা সবাই ই বুঝেছে। জোর করে ঘুমোনোর কথা বলে একে একে বেড়িয়ে গেলো সবাই।
যখন চোখটা বন্ধ করলাম,টের পেলাম রুমে কেউ ঢুকেছে। অনেক কস্টে তাকিয়ে দেখি,ঈশাত। গত তিন বছরে ওর রূপ যেন আরো বেড়ে গিয়েছে। ওর চোখের কোণায় জল যেন ওকে অপ্সরী করে তুলেছে।
ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম,
-তোমার জন্য দুল কিনেছিলাম। চোর নিয়ে গ্যাছে।
কিছুই বললোনা ও। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে যখন আমার কপালে পড়লো,ঈশাত ওর ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল। চোখে পড়লো ওর কানে এক জোড়া সোনার দুল।
চিনতে পারলাম।
মা তার ছেলের হবু বউকে বিয়ের আগেই ঈদ উপলক্ষ্যে নিজের দুলজোড়া উপহার দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসার আগেই প্রচন্ড ঘুম ধরে এলো চোখে। বুঝলাম,আমার বাড়ি ফেরার গপ্পো শেষ হয়েছে।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে টের পেলাম,ঠোঁটের কোনায় আমার এক চিলতে হাসি।
No comments:
Post a Comment