ক্যাথলাস...


(১)
সূর্য অস্তমানের ঠিক পূর্বলগ্নে যখন গীর্জার ঘন্টায় ঢং ঢং করে পাঁচটি ঘন্টাধ্বনি বাজলো,ঠিক তখনি সিস্টার মেরী দৌড়ে ডেভিড পাউলের কাছে আসলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
-পিতা,আপনার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে।

প্রধান ধর্মযাজক ডেভিডের মুখে একঝলক হাসি দেখা গেলো। অত্যন্ত খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-আমার স্ত্রী কেমন আছে?

সিস্টার মেরীর মুখে তৎক্ষণাৎ মেঘের কালো ছায়া নেমে আসলো।
- এল্ডার ভেনেসা প্রসবকালীন সময়ই মারা গেছেন,পিতা।

বিশপ নির্বাক হয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন।
-পিতা,এই মুহূর্তে আপনার বাড়ি যাওয়া প্রয়োজন। 

শান্ত সুরে বিশপ বললেন,
-হ্যাঁ,যাচ্ছি। আর,আমার আত্মীয়দের খবর দাও। শেষকৃত্যের আয়োজন করতে হবে।

গীর্জার প্রধান ফটক থেকে বের হয়ে যখন ডেভিড বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছিলেন,অস্তমিত সূর্যের আলোয় গোরস্থানের ক্রুশ,পাথরগুলো থেকে যেন লাল সূর্যরশ্মি ছিটকে বেরুচ্ছিলো। গোরস্থানের মাঝ দিয়ে যে রাস্তায় বিশপ হাঁটছিলেন,লাল কৃষ্ণচূরা ফুলে রাস্তাটি সেদিন ছেয়ে গিয়েছিলো।

পুত্রশিশুকে প্রথম দেখায় চমকে উঠেছিলেন বিশপ। এ যেন কোন নিষ্পাপ শিশু নয়। কি যেন আছে ওর মধ্যে। ভয় কাটাতে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নাম মিলিয়ে পুত্রের নাম রেখেছিলেন ক্যাথলাস।


(২)
বাইশ বছর বয়সী তরুণ ক্যাথলাস মাঝরাতে যখন মদ্যপান করে মাতাল অবস্থায় ঘরে ফেরে,তখনও তার হাতে একটা সিডারের বোতল থাকে। ডেভিড শুধুমাত্র একটি হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়েন। ছেলেটিকে তিনি মানুষ করতে পারেন নি।

-ক্যাথি..

-হুম বাবা?

-কোথায় গিয়েছিলে?

-এক কথা আর কতদিন জিজ্ঞেস করবে বাবা?

-কারণ তুমি ভুলে যাচ্ছো। ভুলে যাচ্ছো যে তোমার বাবা ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বিশপ। উত্তরাধিকারসূত্রে পরবর্তী বিশপ তোমার হওয়ার কথা। কিন্তু তুমি নাকি ইদানীং ফর্স ল্যাম্বের জাদুটোনার আখড়ায় যাচ্ছো?

ক্যাথলাস চিৎকার করে উঠলো,
-তাতে তোমার কি?আমার উপর তুমি তোমার ঈশ্বরের বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে পারো না..!!

দুলতে দুলতে ক্যাথলাস ঘরে চলে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিশপ জানলায় এসে দাঁড়ালেন। গীর্জার ঘন্টাধ্বনির ঢং ঢং আওয়াজ ভেসে আসছে। বারোটা বাজে।

(৩)
সিস্টার মেরী সুইডেনের সবগুলো নামকরা পত্রিকা বিশপের দিকে এগিয়ে দিলেন। প্রতিটাতেই গুরুত্ব সহকারে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টেন্টদের দাঙ্গার খবর ছাপা হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে প্রোটেস্টেন্টরা আন্দোলন জোরদার করেছে। তাদের মতে,ক্যাথলিকদের সার্বজনীন মতবাদ ত্যাগ করা উচিত। যীশুর কোনো মূর্তিপূজা করা যাবে না। কেননা,যীশু নিজের জীবন দিয়ে গেছেন মানবজাতির জন্য। তার উপর বিশ্বাসই পরকালে মুক্তির জন্য যথেস্ট।

বিশপ উঠে দাঁড়ালেন। প্রচন্ড অশান্তিতে ভুগছেন তিনি। ঘরে বাইরে সব জায়গায় অশান্তি। ক্যাথলাস এসে কখন দাঁড়িয়েছে কেউ খেয়ালই করেনি। মুচকি হেসে বললো,
-ও,পত্রিকা পড়ছিলে বাবা? দাঙ্গার খবর,নাহ?কে জানে..কবে আবার ব্যাপিস্টরাও শুরু করে দিবে !! তাদের মতে তো তোমাদের পোপ,ভ্যাটিকান,রোমান চার্চ অনুসরণও বন্ধ করা উচিত।

-ক্যাথি,তুমি এখন যাও। তোমার হাস্যরস আমাকে পীড়া দিচ্ছে।

-কেনো বাবা,তোমাদের কি শুধু বাইবেলে হয়না? কি প্রয়োজন বাইবেলের বাইরে গিয়ে চার্চ,মূর্তি অনুসরণ করার?

-কি বলতে চাচ্ছো তুমি?

-শয়তানের অনুসারীরা কিন্ত শয়তানের বাইবেল ছাড়া অন্য কিছু অনুসরণ করেনা। আচ্ছা আচ্ছা,আমি চলে যাচ্ছি।

হো হো করে হাসতে হাসতে ক্যাথলাস বেরিয়ে গেলো।

(৪)
কিছুদিন ধরে বিশপ ক্যাথলাসের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন। ছেলেটা তত বাইরে যাচ্ছেনা,মদ্যপানও করছেনা। আচরণ সংযত হয়ে আছে,ঘন ঘন গীর্জাতেও আসছে। ছেলেটা কি তাহলে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হচ্ছে? আহা..!! ডেভিড পাউলের ঘরে যেন শান্তি ফিরে আসছে। উনি তো চাইছিলেন ই,পুত্র উনার পথ অনুসরণ করুক।

ওদিকে সুইডিশ প্রশাসনও ডেভিডকে প্রোটেস্টেন্টদের সাথে আলোচনায় বসার অনুরোধ করেছেন। ধর্ম নিয়ে বারবার দাঙ্গায় সবাই ভীত। বিশপের ইচ্ছে,ইমামদের সাথে পুত্রকে নিয়েই তিনি সেখানে যাবেন।

মীমাংসা অনুষ্ঠানের ঠিক পূর্বরাত্রিতে পুত্রের সাথে রাত্রীকালীন ভোজনে বসলেন বিশপ। ক্যাথি আজ নিজের হাতে বাবাকে খাবার পরিবেশন করছিলো। ইয়োরোপীয় মুলড্ ওয়াইনের গ্লাসটি ছেলের হাত থেকে নিয়ে হাসতে হাসতে যখন চুমুক দিচ্ছিলেন,হঠাৎ অনুভব করলেন কিছু একটা তার গলা বেয়ে নেমে গেলো। বিষযন্ত্রণা অনুভব করলেন তিনি।
অস্ফুট স্বরে বললেন,
-ক্যাথি,এ তুমি কি করলে..!!

-দুঃখিত বাবা,এ ছাড়া আমার উপায় ছিলোনা।

-কিন্তু,কেনো?তুমি জানতেনা আগামীকাল ক্যাথলিকদের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসতো? সকল হিংসা-বিদ্বেষের অবসান হতো?

-সেটাই তো আমার পথে বাঁধা বাবা। শান্তি বিনষ্ট করাই তো আমার কাজ।

ডেভিড ঝাপসা চোখে দেখলেন ক্যাথলাসের চোখ জ্বলজ্বল করছে। চিৎকার করে বললেন,
-কে তুই?তুই আমার পুত্র নস..!!

-আমি কখনোই তোমার পুত্র ছিলাম না। আমি তো খোদ শয়তানের পুত্র। প্রভু জানতো,একদিন তুমি শান্তির দূত হবে। তাই সময়মতো তোমাকে সরাতেই মাতা ভেনেসার গর্ভে আমায় পাঠানো হয়েছিলো।

-তোকে ঈশ্বর কখনো ক্ষমা করবেন না শয়তান।

এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ক্যাথলাস বললো,
-পৃথিবীতে ঈশ্বরের চেয়ে শয়তানের ক্ষমতা অধিক। তুমি কি দেখোনি বাবা? কত সহজে মানুষ অন্যায় করে,ধর্মে ধর্মে ভাগ করে। ক্ষমতাশীল মানুষ নিজের নামে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে।

বিশপ যন্ত্রণায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। ক্যাথলাস সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলতেই থাকলো,
- প্রমিথিউস দেবরাজ থেকে আগুন চুরি করে মানবজাতিকে দিয়েছিলেন। কিন্তু রোম সম্রাট কনস্ট্যান্টিন এসে অলিম্পাস পাহাড়ের বারোজন দেব-দেবীর আরাধনা বন্ধ করে দেয়। তোমাদের ধর্ম মানবের স্বার্থে ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে। শয়তানের বাইবেল,কডেক্স জাইগানটিয়াস কি কখনো বদলেছে?

বিশপের মুখ দিয়ে সাদা তরল পদার্থ বের হতে শুরু করছে। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন,
-একদিন না একদিন সত্য প্রতিষ্ঠা হবেই।

হো হো করে হেসে ক্যাথি উত্তর দিলো,
-দেবতারাই লম্পট ছিলো,আর পরবর্তী মানুষ তো তুচ্ছ। জিউস কি তার লাম্পট্য,ন্যায়ের দেবী স্ত্রী হেরার কাছে গোপন করতেন না? পোসাইডন কি এথেনার মন্দিরে মেডুসার সাথে সহবাস করেন নি? সত্যটা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো?

বিশপ ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছেন। ঘৃণার চোখে পুত্ররূপী শয়তানের  দিকে তাকালেন। ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন,
-একসময় সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী কেউ না কেউ আসবেই।

-আসুক,যে ই হোক। চাইলেও উপেক্ষা করতে পারবেনা আমায়। মহাবিশ্বের ছোট্ট একটা বিন্দুকণা হয়ে হলেও থাকবো আমি।

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ কেটে গেলো। ডেভিড অনেক কষ্টে বললেন,
-ক্যাথি..

-হুম বাবা?

-যীশু আমাকে ডাকছেন। স্বর্গে গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো আমি। আমার মনুষ্য পুত্র হিসেবে তোমাকে চাইবো।
শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে বিশপের গলাটা কেঁপে উঠলো। ক্যাথলাস কোনো উত্তর দিতে পারলোনা।

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বিশপ ডেভিড পাউল। বাবার দিকে তাকিয়ে চোখদুটো ছলছল করছে ক্যাথলাসের। একটা মায়া জন্ম নিতে নিতেও কি জন্য যেন নেয়া হলোনা।

(৫)
বছরখানেক হয়ে গিয়েছে। এক বিকেলে বাবার কবরের উপরে ফুল দেয়ার পর ক্যাথলাস যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছিলো,অস্তমিত সূর্যের আলোয় গোরস্থানের ক্রুশ,পাথরগুলো থেকে যেন লাল সূর্যরশ্মি ছিটকে বেরুচ্ছিলো। গোরস্থানের মাঝ দিয়ে যে রাস্তায় ক্যাথি হাঁটছিলো,লাল কৃষ্ণচূরা ফুলে রাস্তাটি সেদিন ছেয়ে গিয়েছিলো।

হঠাৎ পড়ন্ত সন্ধ্যায় খাদের ধারে ঘন কুয়াশা দেখতে পেলো ক্যাথলাস। মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠলো ওর। কারণ,প্রভু শয়তানের কাছে যাওয়ার রাস্তা ওইটা।

কে জানে..!! হয়তো আরেক বিশপের পুত্র হয়ে পুনর্জন্ম নিতে ডাকছেন উনি।