হারম্যান রিকুলাসকে যখন চারজন রক্তাবসন সন্ন্যাসী চারদিক থেকে ঘিরে প্রধান কক্ষে নিয়ে আসলো,সে নীরবে প্রধান আসনে চোখ তুলে তাকালো। সভাকক্ষে প্রবেশকারী চার সন্ন্যাসী মাথা নুইয়ে মঠাধ্যক্ষকে সম্মান জানালেও হারম্যান তা পারলো না। কারণ,ইতোমধ্যেই সে সন্ন্যাসীর মর্যাদা হারিয়েছে।
মঠাধ্যক্ষ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
- হারম্যান..
- জ্বী,অধীশ্বর?
- তোমাকে যে কারণে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে,সে ব্যাপারে অভিমত?
- আমরা কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই। আমি অপরাধ স্বীকার করছি,প্রভু।
মঠাধ্যক্ষ আসন থেকে নেমে এসে হারম্যানের সামনে দাঁড়ালেন। সভাসদবৃন্দদের দিকে তাকিয়ে রায় দিলেন,
- যেহেতু হারম্যান দুর্বল মুহূর্তের কথা স্বীকার করেছে এবং এরকম অপরাধ ইতোপূর্বে মঠের আর কেউ করেনি,সেহেতু শাস্তিস্বরূপ ওকে বাকী জীবন মঠের ছোট্ট খুপরিতে কাটাতে হবে।
সাঁঝলগ্নের পূর্বাভাগে সূর্যদেবতার কমলা রংয়ের রশ্মি মঠের জানলা ভেদ করে কক্ষে ঢুকছিলো। সেদিকে তাকিয়ে হারম্যান বিষাদ সুরে বললো,
- আমার সাধনার মধ্যবর্তী সময়ে দুর্বল মুহূর্তের শিকার হওয়া কি ঈশ্বরেরই মনোখেয়াল নয়?
মঠাধ্যক্ষ ঈষৎ হেসে বললেন,
- পাপের প্রায়শ্চিত্তের বিধানও কি ঈশ্বরের মনোখেয়াল নয়?
- তবে অধীশ্বর,জিউগোফেগাসের পাপধর্ম কি শেখায়? পূন্য দিয়ে কি পাপক্ষয় করা যায় না?
- কামিনীঘটিত পাপক্ষয় সহজে কমে কি?
হারম্যান চুপ করে রইলো। মঠের ছোট্ট খুপরি সম্পর্কে অবগত সে। ইতিহাসে বেনেডিক্টকে জেনেছে মঠের সন্ন্যাসীরা। সাধু বেনেডিক্ট দীর্ঘজীবন কাটিয়েছেন সেই ছোট্ট খুপরিতে,যেটির খাদ্যগ্রহণের ক্ষুদে ফোকর ছাড়া অন্য কোনো ছিদ্র ছিলোনা। দরজার জায়গায় নিরেট দেয়াল ছিলো। বেনেডিক্ট চেয়েছিলেন সমাজে থেকেও সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যেতে।
হারম্যান হাঁটু গেড়ে মঠাধ্যক্ষের সামনে বসে পড়লো। করুণ সুরে বললো,
- সাধনার দীর্ঘকাল আপনার দীক্ষা মেনেছি। আমায় কি একটা সুযোগ দেয়া যায়না,অধীশ্বর?
- যে মঠকে অপবিত্র করে,সে কোন সুযোগে পবিত্রতায় ভরিয়ে দেবে,বৎস?
- আমি কথা দিচ্ছি,প্রভু। দীর্ঘ সাধনার ফলস্বরূপ এমন কিছু করবো যেখানে মঠের নাম চিরকালের জন্য খ্যাতি লাভ করবে এবং মানুষের সমস্ত জ্ঞান নিহিত থাকবে।
- তাহলে পূর্বাশীয়দের ন্যায় অগ্নিপরীক্ষা দাও। রাজি হবে?
- হবো,অধীশ্বর।
সভাসদবৃন্দদের দিকে পুনরায় তাকিয়ে মঠাধ্যক্ষ চূড়ান্ত রায় দিলেন।
- এক রাতের মধ্যে অপরাধী তার জীবনের সমস্ত জ্ঞান নথিবদ্ধ করবে। সফল না হলে মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য।
.
.
.
হারম্যানকে পাতালঘরে নিক্ষেপ করা হলো। স্নানাগার থেকে স্নান করে নগ্ন দেহে শুদ্ধির উপকরণ গায়ে মাখলো সে। ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনা করে দেয়ালে নিজের নাম খোদাই করলো। প্রার্থনায় বললো,
- ঈশ্বর কি কাছেই আছেন? তবে সমস্ত জ্ঞান এক করে দিন আমায়। জানিয়ে দিন মঠের পবিত্রতা আমার হাতে। ইতিহাসের অংশ করুন আমায়।
প্রার্থনা শেষে ধীরপায়ে টেবিলাকৃতির পাথরের খন্ডের কাছে এসে দাঁড়ালো সে। সেখানে শ'খানেক খচ্চরের চামড়া ও পাত্রে প্রাচীন খুসিয়ার্স কালি রাখা।
সাঁঝের পরলগ্নে যখন বাদুড়ের দল মঠের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো,তখন হারম্যান পাতালঘরে জীবনের সমস্ত অর্জিত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করতে বসলো। ফোঁটায় ফোঁটায় কালি বসতে লাগলো চামড়াতে।
.
.
.
মঠাধ্যক্ষ সাধনালব্ধীয় যজ্ঞ পালনে ব্যস্ততার মুহূর্তে প্রিভেগন প্রবেশ করলেন। গুরুর পাশে বসতে বসতে বললেন,
- সাধনার ইতিহাসে কেউ কি এতো কঠিন পরীক্ষা দিয়েছে,প্রভু?
মঠাধ্যক্ষ হেসে বললেন,
- শীতল পানিয়ের সুধা সবাই ই চায়। ঈশ্বর কি পরীক্ষা ব্যতীত তা দেন?
প্রিভেগন মাথা নাড়াতে নাড়াতে উঠে গেলেন। মনে মনে বললেন,না জানি পাতালঘরে কোন অলৌকিকতা আঘাত হানে..!!
.
.
.
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। চামচিকার তীক্ষ্ণ চিৎকার যখন পাতালঘরে এসে পৌঁছলো,হারম্যান সম্বিৎ ফিরে পেলো। হকচকিয়ে উঠে দেখলো,মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছে। লেখা হয়েছে মাত্র অর্ধপাতা।
দিশেহারা হারম্যান ফের প্রার্থনায় বসলো। ঈশ্বরের কাছে দাবি জানালো সাহায্যের। বেশ খানিকক্ষণ প্রার্থনার পর যখন হারম্যান গভীর ঘোরে চলে গেলো,শুনতে পেলো বহুদূর থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলছে,
"ঈশ্বরকে পাওয়া কি এতই সহজ..!! আমায় ডাকো। আমি আছি।"
হারম্যান লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।তার দেহে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো । দেয়ালে ঝোলানো ড্যাগারটা বাম হাতে তুলে নিয়ে ডান হাতে বসিয়ে দিলো সজোরে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে যখন তর্জনীতে আসতে লাগলো,খচ্চরের চামড়ায় সে চিঠি লিখতে লাগলো। খোদ লুসিফারের কাছে চিঠি। কেননা সে ছোট্ট খুপরিতে যাবজ্জীবন চায়না। বরং অপার্থিব শক্তিতে যদি ইতিহাস গড়া যায়,তা ই সই।
.
.
.
লুসিফারের কাছে আবেদন বোধহয় মন্জুর হয়েছে। ধীরে ধীরে গন্ধকের তীব্র গন্ধে ঘর ভরে উঠছে। দেয়ালের কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে সে। অগ্নিচক্ষুবিশিষ্ট ছাগলরূপী শিংওয়ালা মাথা,কাঁটাখচিত লেজ,খুরযুক্ত পা,হাতে বিশালাকার নখবিশিষ্ট চারটে আঙ্গুল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখ থেকে সাপের মত চেরা লিকলিকে জিভ টা বেরিয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। নারকীয় ভঙ্গিতে এসে হারম্যানের সামনে দাঁড়ালো সে। চামচিকার মত তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
- খোদ স্বয়ং এসেছি আমি,তোমার বাসনা পূর্ণ করতে। বিনিময়ে কি দেবে আমায়?
হারম্যান ঝিলিকযুক্ত হাসি দিয়ে বললো,
- প্রভুত্ব পরিবর্তন করেছি আমি। তুমি প্রভু সন্তুষ্ট নও?
- অবশ্যই সন্তুষ্ট। আমি লিপিবদ্ধ করে দিবো তোমার সমস্ত জ্ঞান। ইতিহাস হবে তুমি।
প্রভু লিখতে বসলেন। পাতার পর পাতা লিখে চলেছেন। হারম্যান মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে। লেখা হতে লাগলো ধর্ম সাধনা সম্পর্কে,কালি ফুরোতে লাগলো রোগ-জ্বরা মুক্তির ব্যাপারে,বর্ণিত হলো ডাকিনীবিদ্যা। বিষয়বস্তু বাড়ার সাথে সাথে হারম্যানের দেহও অবশ হতে লাগলো। ভোর হয়ে আসছে। বাদুড়েরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। হারম্যান তখনও প্রভুর দিকে তাকিয়ে ভক্তিভরে হাসছে।
.
.
.
সূর্য যখন আলোকছটা ছেটাতে শুরু করেছে পৃথিবীতে,মঠাধ্যক্ষ সভাসদদের নিয়ে পাতালঘরে প্রবেশ করলেন।
হায় ঈশ্বর..!! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো সবাই। হারম্যান মাটিতে পড়ে রয়েছে। ওর দেহ নীল বর্ণ ধারন করেছে।
মঠাধ্যক্ষ দৌঁড়ে গেলেন পাথরের খন্ডের সামনে। খচ্চরের চামড়ার স্তূপ সেখানে। কালির পাত্র শূন্য।
ঈশ্বরের নাম জপে বললেন,
- জগতে কতো অলৌকিকতাই তো আছে। হারম্যান তা প্রমাণ করেছে। ঈশ্বর ওর প্রাণকে শুদ্ধ করে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছেন আর মঠকে দিয়েছেন জ্ঞানলব্ধ এই বই..!!
পাতা উল্টোতে উল্টোতে হঠাৎ মঠাধ্যক্ষ আর্তচিৎকার করে উঠলেন। পাতাগুলো হাত থেকে পড়ে গেলো। সবাই দৌঁড়ে আসলেন সেখানে।
এ কী? পাতায় যে লুসিফারের ছবি খোদাই করা।
এ যে,খোদ শয়তানের বাইবেল...!!!
No comments:
Post a Comment