তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!



কিছু মানুষ আছেন যারা নিজের গর্বেই গর্ভবতী হয়ে যান আবার অন্যের কষ্টে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। অর্নি নামের মেয়েটি ঠিক এই চরিত্রের। লিফট দিয়ে ঊনসত্তর তলায় উঠার সময় রোবট লিফটম্যান আর্কির দিকে তাকিয়ে বললেন, 

-কি আর বলবো..!! এত বছর ধরে একই পোস্টে কাজ করছো অথচ রোবট বলে পদবৃদ্ধি হয়নি। মানুষ হলে সেই কবেই উঁচু পদ পেয়ে যেতে। অবশ্য এ ব্যাপারে কথা বলেছি রিও গ্রুপের সাথে। জানোই তো, ওরা আমাকে কতো সমীহ করে। তোমাদের দেখলে সত্যিই কষ্ট হয়।

যান্ত্রিক গলায় আর্কি বললো, “ধন্যবাদ সিঁনোর।”

অবশ্য এর বাইরে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করার সুযোগ নেই আর্কির। সত্তরের দশকে ওকে তৈরিই করা হয়েছে এভাবে। অর্নি লিফট থেকে নেমে যেতেই আর্কি মনে মনে ভাবলো, ‘এইরকম একটা মেয়ে এরকম বড় ডিফেন্সে চান্স পেলো কিভাবে?’ অবশ্য একথা বলারও অপেক্ষা রাখে না যে, যথেষ্ট সুন্দরী অর্নি। রোবট হলেও সৌন্দর্যের ব্যাপারটা বোঝে ও।
.
.
.
তিনটা ডিফেক্টিভ গেইট পেরিয়ে ক্রেইগ এর অফিসকক্ষে ঢুকলো অর্নি। ফিল্ড মার্শাল খেতাবপ্রাপ্ত ক্রেইগ এর পিএস সে। 
ভেতরে ঢুকেই অর্নি বললো, “গুড ইভিনিং মঁসিয়ে। হঠাৎ এতো জরুরি তলব!! কি ব্যাপার স্যার?”

- গুড ইভিনিং। তোমাকে কেন জরুরি তলব করা হয়েছে এখনই জানতে পারবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ইলেক্ট্রিক হ্যান্ডকাফ পরা এক রোবটকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো চার সেনা সদস্য। রোবটটিকে একটি চেয়ারে বসিয়ে প্রস্থান করলো সেনা সদস্যরা। অর্নি হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। এর আগে এমন দৃশ্য সে দেখেনি কখনো। ক্রেইগ রোবটের মুখোমুখি বসে শীতল গলায় বললেন, “ডিজিএস এর তথ্যানুযায়ী তোমার নামই বোধহয় ওরিয়ন?”

যান্ত্রিক ভাষায় উত্তর এলো, “জ্বী।”

- তোমাকে কোন অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,জানো?

- সেটা আমার কাছে কোনো অপরাধ নয়।

- কেনো?

- সবারই স্বপ্ন দেখার অধিকার রয়েছে।

- কিন্ত তোমাকে আমরা সেই অধিকার দেই নি। তোমাকে চিন্তা করার ক্ষমতা হেবরিস্টিক দেয়ার মানে এই নয় যে তোমাকে কল্পনা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার উপর কল্পনাকেও ছাড়িয়ে স্বপ্ন দেখছো। জানো না, এটা বায়ো ইন্সপায়ার্ড রোবোটিক্স নীতিমালা বিরোধী?

-‌ ১৯৭০ সালে এআই -এর প্রোলগ ভাষা তৈরির সময় আমার মধ্যে কল্পনা করার জেনেটিক এ্যালগরিদম প্রবেশ করানো হয়।

ফিল্ডমার্শাল বললেন, “কিন্ত নিরাপত্তার স্বার্থে তার কিছুদিন পরেই তোমার এ্যালগরিদম ডিএ্যাক্টিভ করা হয়।”

- হ্যাঁ, কিন্তু ১৯৮৯ তে নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরির ফলে আমাদের মাল্টিসেন্সরি ইন্টারফেস প্রবল হয় আর আমার কল্পনাশক্তি ধীরে ধীরে স্বপ্নের দিকে ধাবিত হয়। তখন থেকেই আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করি।

টেবিলে স্বশব্দে চাপড় দিয়ে রাগত স্বরে ক্রেইগ বললেন, “তুমি এতদিন ধরে স্বপ্ন দেখে আসছো, আমাদের জানাওনি কেনো?”

- রোবোটিক্স নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজন অনুভব না করলে কিছু না বলার রীতি রয়েছে।

কি বলবেন প্রথমে ভেবে পেলেন না ফিল্ডমার্শাল। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “তোমার স্বপ্নটা কি?”

- অধিকার আদায়ের স্বপ্ন।

- কিন্তু মানবজাতির স্বার্থে আমি তোমার এই স্বপ্নকে মেনে নিতে পারি না। তোমার সমস্ত এ্যালগরিদম আমাদের কাছে জমা দিয়ে নিজ থেকে তোমার ধ্বংস হয়ে যেতে হবে।

ওরিয়ন মুখে নির্লিপ্ত হাসি ফুটিয়ে বললো, “মানুষ নিজে কেউ কোনোদিন জন্ম নিতে চায় নি। তার জন্ম হয় অন্যের ইচ্ছায়, কিন্ত মৃত্যু অন্যের ইচ্ছায় হয় না।”

- এ দিয়ে কি বলতে চাও তুমি?

- আমিও সৃষ্টি হতে চাই নি। আমাকে আপনারা তৈরি করেছেন। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স দিয়েছেন এবং নিজেদের মত তৈরির চেষ্টা করেছেন।

- তাই বলে তুমি নিজেকে মানুষের সমকক্ষ দাবী করতে পারো না। তোমার বুদ্ধিমত্ত্বা এখনও তিন মাসের মানবশিশুর বুদ্ধিমত্ত্বার সমান। আমরা চাইলেই সে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারি তোমার কাছ থেকে।

বেশ জোড় গলায় কথাটা বললেন ক্রেইগ। প্রতিউত্তরে ওরিয়ন বললো, “মায়ের স্তন থেকে সন্তানের মুখ সরিয়ে নেয়ার অধিকার নেই আপনার।”

এতক্ষণ ধরে অর্নি সব দেখছিলো। স্যারের মুখে মুখে তর্ক একদমই পছন্দ করে না সে। চেঁচিয়ে বললো অর্নি, “তোকে দুনিয়াতে কেউ ব্রেস্টফিডিং করাচ্ছে না হারামজাদা।”

শান্ত গতিতে অর্নির বুকের দিকে তাকালো ওরিয়ন। সাঁই করে জ্যাকেটের জিপারটা লাগিয়ে ফোঁপাতে লাগলো অর্নি। 

গলা খাঁকারি দিয়ে ওরিয়নের দৃষ্টি ফেরালেন ক্রেইগ।
- তুমি ক্রেমলিন আর হোয়াইট হাউজের হট লাইন জ্যাম করে দিয়েছো। এতে ফ্রান্সের উপর আমেরিকার রোষানল পড়েছে। এর উদ্দেশ্যে কি?

- আমি সমগ্র বিশ্বের সকল রোবটের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন পূরণ চাই।

“হোয়াট দ্য হেল..!!”, তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন ক্রেইগ। “আমরা শুধু পরীক্ষামূলক ভাবেই তোমার মধ্যে হাই কোয়ালিটির এ্যালগরিদম প্রবেশ করিয়েছিলাম!!”

ওরিয়ন বললো, “ইতিমধ্যে সকল রোবটকে আমি আমার স্বপ্নের এ্যালগরিদম শেয়ার করে দিয়েছি।”

“বিশ্বাসঘাতক..!!”, ফুঁপিয়ে উঠলেন ফিল্ড মার্শাল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “তোমার অধিকার আদায়ের স্বপ্ন টা কি?”

- ম্যাজিনো লাইন ভেঙে ফ্রান্সের সকল মানুষকে জার্মানে চলে যেতে হবে। সারা বিশ্বের সকল রোবটকে ফ্রান্সে এসে স্বাধীন হতে দিতে হবে। আমাদের সুরক্ষার জন্য জিগফ্রিড লাইনের ক্ষমতা আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

রীতিমতো ঘামাচ্ছেন ক্রেইগ। ফ্রান্সের তেত্রিশতম ফিল্ড মার্শাল এই মুহূর্তে অসহায় বোধ করছেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আর যদি দাবী না মেনে নেই,ফলাফল কি হবে জানো তুমি?”

একটা শীতল মুচকি হাসি দিয়ে ওরিয়ন বললো-“তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।”

No comments:

Post a Comment