জলকন্যা


(১)
আসগর মেম্বার পুকুরের ঘাটে বসে আছেন। জলকন্যার আশায়।

আজ পূর্নিমার রাত। বানভাসি জ্যোছনায় ছেয়ে গিয়েছে মাঠ-ঘাট। গাছের পাতাগুলো যেন সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। পুকুরের পানিতে জ্যোছনার আলোয় সাদাকালো যে ছায়া-প্রতিচ্ছায়ার সৃষ্টি হচ্ছে সেদিকে আসগর মেম্বারের দৃষ্টি পড়ছেনা। ওনার দৃষ্টি শান-বাধানো ঘাটের পানিতে। আজ যে জলকন্যার ভেসে উঠার কথা।

আসগর মেম্বারের চোখে হঠাৎ পানিতে নড়াচড়ার উপস্থিতি ধরা পড়লো। ঘাটের পানিতে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। কিছু একটা উঠে আসছে। একটা অবয়ব,তরুণীর অবয়ব। হ্যাঁ,এক সুন্দরী তরুণী। সিক্ত দেহে ঘাটের সিঁড়িগুলো বেয়ে উঠে আসছে সে। তরুণীটি আসগর মেম্বারের সামনে এসে দাঁড়ালো। আসগর মেম্বার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তরুণীর মুখপানে। অতি নিষ্পাপ একটা মুখ। চাঁদের আলোয় মুখখানা ঠিক পরীর মত লাগছে। নাহ্,পরী না। পরীরা তো আসমানে থাকে। কিন্তু যেসব পরী জলে থাকে? জলপরী? জলপরীদের মুখ কি নিষ্পাপ থাকে? এ জলপরী নয়,জলকন্যা..!!

আসগর মেম্বার মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত এক মায়া অনুভব করলেন,নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে জলকন্যার গালে হাতটা ছোঁয়ালেন।
ভেজা গালে হাত রেখেও টের পেলেন মেয়েটা কাঁদছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ মেয়েটা কাঁদছে..!! আসগর মেম্বারের চোখের কোণেও পানি আটকে আছে। বের হতে পারছেনা। আসগর মেম্বার কাঁদতে চাচ্ছেন,পারছেন না। দু'বার চেস্টা করলেন। পারলেন না। 

(২)
- স্যার,ও স্যার..

আসগর মেম্বার ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তার চোখের কোণে পানি জমে আছে।
- কি অইছে? মাঝরাইতে ডাক পারোস ক্যান?

- চেয়ারম্যান সাবের ফোন।

হাত বাড়িয়ে মজিদের হাত থেকে ফোন নিলেন আসগর মেম্বার।
- সালাম চেয়ারম্যান সাব। এই মাঝরাইতে কি ব্যাপার?

- খবর তো ভালা না মিয়া। কর্ণফুলীত সবিরের লাশ পাওন গেছে। সামনে মেম্বার ইলিকশন। তোমারে নিয়া তো চিন্তায় আছি।

- আমারে এইবার ছাড়ান দ্যান চেয়ারম্যান সাব। তিরিশ বছর মেম্বারি করছি। আর কত..!! খুনাখুনি আর ভাল্লাগেনা। আমারে ছাড়ান দ্যান। সালাম।

ফোনটা কেটে দিলেন আসগর মেম্বার। তার মন একটু বেশিই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বাইরে বেশ জ্যোছনা হয়েছে। রাতপাখিদের উড়োউড়িও দেখা যাচ্ছে। টিনের চালে অজানা কোন পাখি যেন ডানা ঝাপটালো..

(৩)
দুপুরের রোদে খা খা করছে চারদিক। নীলাকাশ থেকে আগুনতর রোদ ছিটকে এসে পড়ছে যেন। মাটি ফেঁটে ফেঁটে এখানে-সেখানে হাঁ হয়ে আছে। আসগর মেম্বার পুকুরঘাটে এসে দাঁড়ালেন। কি শান্ত টলটলে পানি..!! দূরে কাঁঠাল গাছটার নিচে একটা কুকুর জিভ বের করে বসে বসে কাঁপছে। একটা কাক বোধহয় উড়ে গেলো গনগনে আকাশ চিড়ে। আসগর মেম্বার খেয়াল করতে পারলেন না। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন পুকুরের পানির দিকে। শান্ত টলটলে পানিতে শুধু বিশ-বাইশ বছর আগের স্মৃতিই ভাসছে যেন।
আসগর মেম্বারের চোখে সেদিন যেন গনগনে আগুন ঝরে পড়ছিলো। মরিয়মের চুলের মুঠি ধরে মাটিতে হ্যাঁচকা টানে ফেলে দিয়েছিলেন।

- ওই ছিনাল,বাচ্চা অইলো ক্যামনে? তরে ট্যাকা দেইনা?

মরিয়মের পেট বাড়িয়ে প্রচন্ড এক লাথি কষিয়েছিলেন সেদিন। সাতমাসের অনাগত প্রাণীটা রক্ত নিয়ে মেঝেতে উঁকি দিয়ে তড়পিয়েছিলো খানিকক্ষণ। সাথে সাথে প্রচন্ড চিৎকারে মরিয়ম জ্ঞান হারিয়েছিলো। সে জ্ঞান আর ফিরেনি।

অনাগত যে প্রাণীটা আগত হয়ে গিয়েছে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন আসগর মেম্বার। থানা-পুলিশের ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হতোনা। নিজের বউ এমনকি গ্রামবাসী এতদিন ধরে সবকিছু জানলেও প্রমাণ না রাখলেই পুলিশ টিকিটাও ধরতে পারবে না। অবৈধ সন্তানের মৃতদেহটা বস্তায় পুড়ে সাথে কিছু ইট বেঁধে নিজ পুকুরে ফেলে দিলেন তিনি,প্রমাণাদি খতম।

থানা-পুলিশ হলে ইলিকশনে সমস্যা হবে। তাই চেয়ারম্যান সাহেব মরিয়মের ঘটনাটা রক্তবমিতে নিয়ে গিয়ে পরপর দু'বার জিতে যাওয়া আসগর মেম্বারকে সে বারও দাঁড় করিয়ে দিলেন। ভোটে জিতে গেলেও নিজের ঘরের বউ আয়েশার ভোট পান নি। তালাক দিয়ে সে বাপের বাড়ি চলে গেলো।

পরপর ছয়বার কোন ভাগ্যগুনে মেম্বার হয়েছেন তা আজও বুঝেননি তিনি। বিয়ে থা'ও আর করেন নি।

হঠাৎ মজিদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন।
- স্যার,খাইতে চলেন। দুপুর অইয়া গেছে..

- আইতাছি,তুই যা।
ঘরে ফিরতে গিয়ে আবারও কি কারণে যেন পুকুরের পানিতে তাকালেন আসগর মেম্বার। 

(৪)
আসগর মেম্বার পুকুরঘাটে বসে আছেন। জলকন্যার আশায়।

চারদিকে মৃত্যুনিস্তব্ধতা। গাঢ় অন্ধকারে গাছের পাতা,পুকুরের পানি সব যেন মিশকালো হয়ে আছে।
হঠাৎ মেঘের পিছন হতে চাঁদ বেড়িয়ে এলো,জ্যোছনায় ছেয়ে গেলো আশেপাশের প্রান্তর। ঘাটের পানিতে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। কিছু একটা উঠে আসছে,একটা অবয়ব,তরুণীর অবয়ব। জলকন্যা..!!

জলকন্যার গায়ে বিয়ের লাল শাড়ি দেখতে পেলেন আসগর মেম্বার। মেয়েটা এসে তার সামনে দাঁড়ালো। আগের মতই নিষ্পাপিনীর গালে হাত রাখলেন। মেয়েটা কাঁদছে। তপ্ত চোখের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় আসগর মেম্বারের হাত বেয়ে পড়তে লাগলো। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বলে উঠলো,

- আব্বা..!! আমারে বিয়ার শাড়ীতে কেমন লাগতাছে?

- আমারে বাপ কইস না মা। আমি বাপের যোগ্য না।

- বস্তায় পুইরা পানিত ফালায়া দিছো বইলা তোমারে বাপ কমু না বুঝি? কি কও আব্বা..!! তুমি না আমারে জন্ম দিছো? দেহো আব্বা দেহো,আমি বিয়ার শাড়ি পড়ছি। আমারে কেমন লাগতাছে আব্বা?

- অনেক সুন্দর রে মা। সেইদিন যদি তরে মাইরা না ফালায়া দিতাম,তাইলে আইজ তুই এইরহম শাড়ী পইড়া শ্বশুরবাড়ি যাইতি। তুই নিষ্পাপরে মা আমি ঘরে না তুইলা পানিত ফালাইছি। আমারে মাপ কইরা দে রে মা,মাপ কইরা দে..ঘরে চল..

- ছিহ্ আব্বা,কি কও? তুমি তো আমার বাপ। অবৈধ সন্তানগো বাপ থাকে,ঘর-পরিচয় থাকতে অয় না। বিশ বছর আগে এইখানে ফালায় দিছো,আমি এই পানিতে খুব ভালা আছি আব্বা। ঘরে যামু ক্যামনে? আমি না জলকইন্যা? যাই আব্বা?

- যাইস না মা,দোহাই লাগে,যাইস না..
হাত ছাড়িয়ে জলকন্যা ধীরে ধীরে ধোয়াশায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। আসগর মেম্বার হাত বাড়ালেন,কিছু ধরতে পারলেন না।

(৫)
ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন আসগর মেম্বার। এদিক-ওদিক তাকালেন। কিছুই চোখে পড়লোনা। ঘর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। চারদিক জ্যোছনায় ছেয়েছে। রাতপাখিরা আকাশে উড়োউড়ি করছে।

উদভ্রান্তের মত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন আসগর মেম্বার। দৌড়োচ্ছেন তিনি। উর্ধ্বশ্বাসে। পুকুরঘাটে এসে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। শান্ত টলটলে পানির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,

"অ মা,যাইস না। দোহাই লাগে রে মা,আমার কাছে আয়। আমারে মাপ কইরা দে রে মা,দোহাই লাগে,যাইস না..."

পেঁয়াজ


- ভাইজান,আজকে দুপুরের খাওনে কি রানমু?

- আপনি আমাকে ভাইজান ডাকতেছেন কেনো? আমি কি আপনার ভাইয়ের বয়সী? আপনার বয়স চল্লিশের উপরে আর আমার মাত্র তেইশ।

- ওই একটা ডাকলেই অইলো..

কথাগুলো বলার সময় মর্জিনা বেগমের ভাঙা দাঁতগুলোর ফাঁক দিয়ে থুতু ছিটকে মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো।

- যা ইচ্ছা রান্না করেন। আর পরবর্তীতে যেন আপনার মুখে ভাইজান ডাক না শুনি। মামা অথবা নাম ধরে ডাকবেন।

কথাগুলো রাগের স্বরে বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন সিদ্দিকুর রহিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। পঠ্য বিষয়-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এছাড়াও তার আগ্রহ আছে অশরীরী জগত নিয়ে।

পরেরদিন আবারও মর্জিনা বেগমের সেই একই প্রশ্ন,ভাইজান,আজকে দুপুরের খাওনে কি রানমু?

সিদ্দিকুর রহিম বোধহয় পাগল হয়ে যাবেন। এই মহিলার মাথায় কি সমস্যা আছে? ছেলের বয়সী একটা পুরুষকে ভাইজান ডাকে কোন হিসেবে? নাহ,কাজের বুয়া বোধহয় এইবার পাল্টাতেই হবে।

শহরাঞ্চলে কাজের বুয়ার বড্ডো অভাব। তার উপর বেতন চওড়া। আকাল না পড়লে এই বুয়াকে কবেই বিদেয় করে দিতেন..!!

মর্জিনা বেগম একবেলাই আসে। দুপুরের খাবার রান্না করে দিয়ে চলে যায়। সিদ্দিকুর রহিম সেই খাবারের অর্ধেক দুপুরে,বাকী অর্ধেক রাতের বেলা নিজেই গরম করে খান। একটু বেশি কথা বললেও মহিলার রান্নার হাত খুবই চমৎকার,কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন তিনি।

আজ বড়ই ক্লান্তি লাগছে। প্রেজেন্টেশন ছিলো। সারাদিন এর পিছনেই খাটতে হয়েছে। আর এত কষ্ট করে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেই বা লাভ কি? ক্লাশে যে একটা সুন্দরী মেয়েও নেই। ইশ,যদি একটা পরী থাকতো..!! ছোটবেলায় কতো গল্প শুনেছেন-পরীরা নাকি সুন্দরী নারীদের চেয়েও অতি বেশি সুন্দরী,তাদের গায়ে নাকি এক টুকরো জামাও থাকেনা। আহা..!!

সিদ্দিকুর রহিমের এক মামা বলেছেন এসব কথা। তার কাছে নাকি নিয়মিত এক পরী আসতো। এমন কালো লোকের কাছে পরী আসতো? সিদ্দিকুর রহিম এইদিক দিয়ে রাজপুত্র বলা চলে। তিনি আরও শুনেছেন পরীরা নাকি ফর্সা ছেলেদের পছন্দ করে বেশি। তাহলে তার কাছে আজও কেনো একটা পরীও ধরা দিলোনা? একরাশ হতাশা নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি।

মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো সিদ্দিকুর রহিমের। খাটের বামদিকের জানালাটা খোলা। হুরহুর করে সেখান দিয়ে দখিনা বাতাস ঢুকছে। চাঁদের আলো সরাসরি তার খাটে পড়ছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। চাঁদের তীব্র আলোতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছে।

কিন্তু যতদূর মনে পড়ে,জানালা বন্ধ করেই তিনি ঘুমিয়েছিলেন। তাহলে খুললো কিভাবে? ডানদিকে কাত হতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কে যেন বসে আছে খাটের পাশে। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতেই সিদ্দিকুর রহিম বুঝতে পারলেন,এ যে একটা মেয়ে..!!

দরজার ছিটকিনি বন্ধ,তা ছাড়া এটা তিনতলার একটা রুম। এখানে জানালা দিয়ে মেয়ে ঢুকবে কিভাবে? আতংকিত অবস্থায় সিদ্দিকুর রহিম জিজ্ঞেস করলেন,
- কে,কে আপনি?

মেয়েটা মুখ তুলে চাইলো। সিদ্দিকুর রহিম উপলব্ধি করলেন,এতো সুন্দর মেয়ে বোধহয় তার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। অতি সুন্দর একটা মুখ,ঘনকালো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। ছিপছিপে দুধসাদা নগ্ন দেহের দিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে তিনি তাকিয়েই আছেন। তার দিকে তাকিয়েই মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো।

এতক্ষণে সিদ্দিকুর রহিম ধারণা করতে পারলেন,এ পরী না হয়েই যায় না..!!

মেয়েটি আস্তে আস্তে তার দিকে সরে আসছে। সিদ্দিকুর রহিমের দেহে রক্তের গরম স্রোত খেলে গেলো। নিজের অজান্তেই তেইশ বছরের ক্ষুধা যেনো জেগে উঠলো। পরীর মুখ তার মুখের কাছে আসতে থাকলো। ঠোঁটে ঠোঁট লাগার পূর্বমুহূর্তে সিদ্দিকুর রহিম হঠাৎ টের পেলেন,পরীর মুখ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ আসছে। আশ্চর্য ব্যাপার..!!

কে জানে,হয়তো পরীদের মুখ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ বের হওয়াই নিয়ম,হয়তো কেউ ই জানেনা এ কথাটা। সে যাকগে,ব্যাক্তিগতভাবে পেঁয়াজের গন্ধ অপছন্দ করলেও এই মুহূর্তে তা কিছুই নয়। বরং জৈবিক চাহিদায় অতি সুন্দরীর মুখে পেঁয়াজের গন্ধই শ্রেষ্ঠ।

ততক্ষণে দুজন দুজনকে জাপ্টে ধরেছে। দলাই-মলাই চরম মাত্রায় পৌঁছেও গিয়েছে। সিদ্দিকুর রহিম বুঝতে পারলেন,এই অতি সুন্দরী তার স্বপ্ন পূরণ করতেই যেন এসেছে। ধীরে ধীরে তার সমস্ত যৌবনশক্তি যেন শুষে নিচ্ছে..!!
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই সিদ্দিকুর রহিমের গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো। বেশ ভালো একটা স্বপ্ন দেখা হয়েছে গতকাল।

কিন্তু এ কি,তার গায়ে যে কোনো কাপড় নেই..!! বামদিকে তাকাতেই দেখা গেলো জানালা খোলা। কিন্তু কাল তো কপাট লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। বিছানার দিকে তাকাতেই অবাক হওয়ার পালা। এখানে ওখানে মেয়েমানুষের মাথার বড় বড় চুল ছড়িয়ে আছে।

তাহলে কি স্বপ্ন ছিলোনা গতকাল রাতের ঘটনা...??

দরজায় টোকা পড়তেই তাড়াতাড়ি জামা পড়ে দরজা খুলে দিলেন। মর্জিনা বেগম এসেছে। দরজা খুলে দিয়েই ফের বিছানায় বসে পড়লেন তিনি। সিদ্দিকুর রহিমের মাথা ঘুরছে। সত্যিই কি তাহলে পরীর অস্তিত্ব আছে?

অবশ্যই আছে। এই যে তার প্রমাণ। খোলা জানালা,একটু আগের বস্ত্রহীন দেহ,খাটে মেয়েমানুষের চুল। প্রথমে ব্যাপারটা মেনে নিতে না পারলেও সিদ্দিকুর রহিমের মুখে এখন অস্বাভাবিক খুশির হাসি। এক আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে।

মর্জিনা বেগম সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রতিদিনের মত একই প্রশ্ন,ভাইজান,আজকে দুপুরের খাওনে কি রানমু?
সিদ্দিকুর রহিম মুখ তুলে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকালেন। তাকিয়ে দেখলেন,মর্জিনা বেগম মিটমিট করে হাসছে।
মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো তার। তিনতলা থেকে এই মহিলাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে এখন।

আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। বেঢপ আকৃতির চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলা,যার ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ছিটকে দুনিয়া ভেসে যায়,সে কিনা সিদ্দিকুর রহিমকে ভাইজান বলে? এই বেটি কি জানে,সিদ্দিকুর রহিম কে? তার কত ক্ষমতা? যার কাছে পরী এসে ধরনা দেয়,তাকে ভাইজান বলে এই কুৎসিত মহিলা,তাও কাজের বুয়া?

পরীকে বললে কত খাবার এনে দিবে..!! এইসব ফালতু বুয়া-টুয়ার কোনো দরকার নেই। সটান হয়ে মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি,বড় করে একটা ঝাড়ি দিবেন বলে।

মর্জিনা বেগম ঠিক তখনই বলে উঠলো,
- কি অইছে ভাইজান,খাড়াইলেন ক্যান? কি রানমু হেইডা কওয়ার জন্য খাড়াইতে অইবো না।

তখনও মিটমিটিয়ে হাসছে মর্জিনা বেগম।

ঝাড়ি দিতে গিয়েও থমকে গেলেন সিদ্দিকুর রহিম,আর ঝাড়ি দেয়া হলোনা। আতংকে পা জমে গিয়েছে,গলা কাঠ হয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড বিষ্ময়ে তিনি যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন। কারণ,

মর্জিনা বেগমের মুখ থেকে ভসভস করে পেঁয়াজের গন্ধ বেরুচ্ছে...!!

কালদেবতার পাহাড়



- শূকর,চুমু খাবে আমায়? তাহলে জন্ম পরিবর্তন করো। এজন্মে শূকরের ঠোঁটে চুমু খাই কি করে..!!

কথাগুলো যখন উন্নত বুক থেকে স্বরথলি চিড়ে অট্টহাসির সাথে বেরিয়ে আসছিলো জুলিয়ার,আর্মেতাস তখনও কুঁজো পিঠটাকে সোজা করতে চেয়ে পারছিলো না। তার মুখে প্রচন্ড যন্ত্রণার ছাপ দেখেছিলাম সেদিন আমি।

ভেনিসের সবচেয়ে দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম আমি। ফিদালেলের সবচেয়ে কুৎসিত যুবকটাও আমার সাথেই পড়তো। ভাগ্যিস বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। নয়তো ওর কুৎসিত দেহটা দেখলেই না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া হতো।

হাড়ের সাথে কালো বিষ্ঠার মতো লেগে থাকা চামড়ায় যেন সবার ঘেন্না ছিটকে পড়তো। ঘেন্নাটা তীব্রতর হতো ওর কুঁজো পিঠটায়। খর্বাকার আর্মেতাসের রোম সাম্রাজ্যের চিহ্ন-থ্যাবড়ানো নাকটা একটু অধিক বড় ছিলো বলেই হয়তো চেহারাটা শূকরের ন্যায় লাগতো কয়েকজনের কাছে। আমার কাছেও তাই ই মনে হতো। তবে এই কুৎসিত মানুষটাও আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলো শুধু ওর চোখের জন্য।

আর্মেতাসের কদাকার মুখে ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া। যে চোখের অভিজ্ঞতা আছে ভারতের রেইন ফরেস্ট থেকে শুরু করে তিব্বতের পর্বত,সব কিছু। সে চোখে যেন আমি ভারতের নাগা সন্নাসী যারা লিঙ্গে কেজি বিশেক ভার টানতে পারে থেকে শুরু করে তিব্বতের লামাদের শতবর্ষীয় যৌবনের গুপ্তসূত্র দেখেছিলাম। আর্মেতাসের চোখ ঠিকরে যে বুদ্ধির ধারা ঝড়তো সে ধারায় যেন গোটা বিশ্বকে দেখতে পেতাম আমি..!!
.
.
.
সেদিন লাইব্রেরীতে বসে হান্স ক্রিশ্চিয়ানের জীবনী পড়ছিলাম। আর্মেতাস ঘরে উঁকি দিলো। আমি তাকে দেখে একগাল হেসে বললাম,
- এসো আর্মে,কি খবর তোমার? বসো।

সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে আর্মেতাস বললো,
- আমায় একটা ঘোড়ার গাড়ি দিতে পারো,মার্কো?

- তা না হয় ব্যবস্থা হবে ক্ষণ। কিন্তু যাবে টা কোথায়?

- ওকলায়েমো সিঁতেরা'য়।

আমি রীতিমতো ধ্বাক্কা খেলাম। চোখজোড়া যেন কপালে উঠলো। গলার স্বর নিচু করে বললাম,
- মানে? কেনো? ওই জায়গাটা তো অভিশপ্ত। বাবার কাছে শুনেছি,কালদেবতার পাহাড় সেখানে। ওখানে যাবে কেনো?

- দরকার আছে।

- কি দরকার?

- না জানলেই কি নয়? দিতে পারবে নাকি সেটাই বলো।

- ও পাহাড়ে যেতে গিয়ে যদি ঘোড়া মরে যায়?

- অতদূর লাগবেনা। আর ক্ষতি হলেও পুষিয়ে দেবো।

আমি হেসে বললাম,
- ঠাট্টা করছিলাম। তোমার জন্য ঘোড়া মরলেও ক্ষতি নেই। আমি কি যেতে পারি সঙ্গে?

আর্মেতাস খানিকক্ষণ ইতস্ততা করে বললো,
- ঠিকাছে। পরশু রওনা দেবো।

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,তা হলে দুটো ব্র্যান্ডি হয়ে যাক?

আর্মেতাস কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম,নিশ্চয়ই বড়সড় কিছু ঘটেছে।
.
.
.
দুদিন পর রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে বেশ ভালোভাবেই আঁটঘাট বেঁধে রওনা দিলাম ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। আর্মেতাসকে বেশ চিন্তিত লাগছিলো।

- তোমায় বেশ চিন্তিত লাগছে আর্মে। আমায় বলা যায় না ব্যাপারটা?

- বের হয়েছো যখন,একসময় না একসময় তো জানতেই পারবে মার্কো।

- তবে এ প্রসঙ্গ আপাতত বাদ। কিন্তু কালদেবতার পাহাড়ে পৌঁছবো কিভাবে?

আর্মেতাস একটা ম্যাপ মেলে ধরলো সামনে। আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে লাগলো। প্রথমে ঘোড়ার গাড়িতে আলেসান্দ্রো শহরের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামবো। তারপর একদিন হাঁটতে হবে গুইসিপ্পির প্রান্তর ধরে। প্রান্তের শেষে যে গিরিখাত আছে সেটা পেড়িয়ে গেলেই লুইগির জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে তা ধরে এগোলে তিনদিন পর ওলাপ্পা গ্রাম। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিলেই দেখিয়ে দেবে।

- ম্যাপে কালদেবতার পাহাড় কোথায়?

- বই পুস্তকে ওলাপ্পা গ্রাম পর্যন্তই দেয়া আছে। কালদেবতার পাহাড় মুখে মুখে প্রচলিত।

- ও পাহাড় যে সত্যিই আছে তার প্রমাণ কি?

- তুমি এখন আলেসান্দ্রো শহরে আছো তার প্রমাণই বা কি?

- আমার গাড়ির জানলা খুললেই তো বোঝা যাবে।

আর্মেতাস মুচকি হেসে বললো,
- তাহলে আমারটাও ওলাপ্পা গ্রামে পৌঁছলেই বোঝা যাবে।

আর্মেতাসের দূর্দান্ত কথার কাছে সর্বদাই আমি হেরে যাই। একগাল হাসা ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকেনা। এবারও তাই ই করলাম। হেসে বললাম,
- তা আমাজনে রাত কেমন কাটালে?

আর্মেতাস জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
- ভালোই,রেড পাইথনের সাথে রাত কাটিয়েছি আর কি।
.
.
.
পাঁচদিন যাত্রার পর কাঁদা-জংলা পেড়িয়ে অবশেষে ওলাপ্পা গ্রামে পৌঁছলাম। হলুদ মাটির বিরান এই প্রান্তরেই মেগেরীন উপজাতির বাস।

দুধ,কিউবার্তের ফল খাইয়ে আর হাতির বিষ্ঠা মাথায় ছুঁইয়ে বরণ করা হলো আমাদের। এখানে হাতিদের পবিত্র প্রাণী মনে করা হয়। একরাত থাকার পর যখন জানালাম যে আমরা ওকলায়েমো সিঁতেরা'য় যেতে চাই,ভয়ার্ত কন্ঠে মেগেরীন রাজা আমাদের যেতে নিষেধ করলেন। ওই অভিশপ্ত পাহাড়ে গেলে নাকি ভ্রমণকারীর গায়ে অভিশাপ পড়ে। কালদেবতার অভিশাপ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে সারা জীবন জুড়ে।

আর্মেতাস সেসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে পাহাড়ের ঠিকানা জেনে যাত্রা শুরু করলো। আমাদের বিপদ যাতে কিছুটা কমে সেজন্য মেগেরীন রাজা হাতির দাঁত থেকে তৈরি একজোড়া ব্রেসলেট পড়িয়ে দিলেন।

তিনরাত-তিনদিন একটানা ঘন জংলার পথ পাড়ি দিলাম আমরা। গোটা পন্ঞ্চাশেক জোঁক,দশখানা সাপ,গোটা তিনেক কুমিরের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর নিজেদেরই কালদেবতা মনে হচ্ছিলো। কাঁদামাটিতে মাখা মুখ আর জায়গায় জায়গায় ছড়ে যাওয়া আমায় বীভৎস লাগছিলো বেশ। আর্মেতাসের কথা তো বাদই দিলাম।

যেদিন জংলা বাদে উঁচু উঁচু ভূমি দেখতে পেলাম,সেদিন বুঝলাম যে,ওকলায়েমো সিঁতেরা'য় পৌঁছে গেছি। দুপুর নাগাদ সে বিশাল পাহাড়ের সন্ধান পেলাম।

এই সেই কালদেবতার পাহাড়..!!

পাহাড়ের ধারে আসতে আসতে সূর্য হেলে পড়লো। আর্মেতাস এমনিতেই স্বল্পভাষী মানুষ,তার উপর দুপুর থেকে একদমই চুপ করে গেছে। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিচ্ছেনা,শুধু হেঁটেই চলেছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা নেমে এলো। দেখলাম আর্মেতাস এক গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

- আমাদের কি এই গুহামুখে ঢুকতে হবে এখন?

আর্মে জবাব দিলো,হ্যাঁ।

- তুমি কি এই জায়গাটা আগে থেকেই চেনো?

- না।

- তাহলে এতো অনায়াসে বের করে ফেললে যে?

- মেগেরীন রাজা বলেছে,এরকম শত শত গুহামুখ এই পাহাড় জুড়ে আছে। সবকয়টাই এক জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়েছে।

আমি ততক্ষণে অভিযানে নতুন মোড় পেয়ে গেছি। উৎফুল্ল হয়ে বললাম,
- চলো তাহলে,ভেতরে ঢোকা যাক?

- মশাল প্রয়োজন।

- সে আমি বানাচ্ছি..
.
.
.
গুহার দেয়াল ধরে হাঁটছি। পিচ্ছিল,শ্যাওলা পড়া,স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। কিলবিল করে কিসব পোকামাকড়েরা দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেয়াল প্রশস্ত হতে লাগলো। লাইমস্টোন চোখে পড়লো। তার মানে সামনেই কোথাও পানির স্রোত আছে।

একসময় সত্যিই পানির স্রোতের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু এ কি..!! এ তো পানির স্রোত নয়। দুধের মত সাদা তরল পদার্থ বয়ে চলেছে নালা ধরে।

আর্মেতাস একটা বয়াম বের করে খানিকটা তরল পদার্থ পুরলো। সেটা ব্যাগে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
- চলো,ফেরা যাক।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,ও বস্তু কি?

আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- আথ্রোপেড্রো। চিরযৌবন পানি।

আমি ফিক করে হেসে শুধোলাম,
- তোমার জন্য?

- না,জুলিয়া চেয়েছে।

এতসব পাগলামি আর তীব্র বিশ্বাসের বহর দেখে হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে ওর পিছু পিছু গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম।
.
.
.
ভ্যালেন্টিনার মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর্মেতাস আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। খট খট শব্দ তুলে জুলিয়া এসে সামনে দাঁড়ালো।
- কি হে শূকর,এনেছো আথ্রোপেড্রো?

আর্মেতাস বয়াম টা বের করে জুলিয়ার হাতে দিলো। জুলিয়া ক্ষিপ্রবেগে যেন বয়ামটা হাতে নিয়ে নিলো।
- সত্যিই আথ্রোপেড্রা তো?

আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- শূকরেরা কখনও ধোঁকা দেয়না।

জুলিয়া অট্টহাসি হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো,
- তা যা বলেছো। মনোবাসনা পূর্ণ করবে? সুযোগ দিচ্ছি আমি।

- কি সেটা?

- চুমু খাবে আমায়?

আর্মেতাস উত্তর দিলো,
- ক্ষণস্থায়ী রূপে চুমু খাবো কেনো? আথ্রোপেড্রা টা পান করো। দীর্ঘস্থায়ী রূপেই চুমু খেতে দিও।

জুলিয়া হেসে বললো,
- সে না হয় শূকরের একটা ইচ্ছে চিরযৌবনা হওয়ার পরেই পূরণ করবো ক্ষণ।

পরমুহুর্তেই বয়ামের ঢাকনা খুলে এক চুমুকে সম্পূর্ণ তরলটাই গলাধঃকরণ করে ফেললো জুলিয়া।

আর্মেতাস চোখ বড় বড় করে জুলিয়ার পান করার দৃশ্য দেখলো। ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়ায় এই প্রথম আমি অন্যকিছু দেখতে পেলাম যেটা আমায় কিছু লুকিয়েছে।
.
.
.
মন্দিরের রাস্তা ধরে হাঁটছি। আর্মেতাসও আমার পাশে পাশে হাঁটছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। এই মুহূর্তে ওকে ঠিক শূকরের মতোই লাগছে।

উত্তরে বেশ দারুণ বাতাস বইছে। তীব্র মাথা ঘুরোচ্ছে। কি ঘটে গেলো,এখনও বুঝতে পারছি না। তাজা বাতাসের জন্য বুক ভরে একটা শ্বাস নিতেই বমি করে ফেললাম।

মন্দিরের মাংসপঁচা গন্ধ টা এখানেও এসে পড়েছে..!!


লা বেস্টিয়া লুইস


- প্রমাণিত হওয়া খুনীর ১৩৮ টি খুনের শেষ ৬ টি'র বর্ণনা তুলে ধরছি জুরি বোর্ডের সামনে।

কথাটি বলে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন এ্যাডি। গত দুইদিন ধরে ১৩২ টি খুনের রেকর্ড পড়ে শোনাতে হয়েছে তাকে। স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত সে।

গ্যাব্রিয়ানো বলে উঠলেন,
- শুয়োর জানি কয়টা খুন করেছিলো?

- ধারণা করা হয় চার'শ টা। প্রমাণাদি মিলেছে ১৩৮ টা।

- নাম কি হারামজাদার?

এ্যাডি এইবার গ্যাব্রিয়ানোর দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালেন।
- আপনার বোধহয় এইবার অবসর নেয়া উচিত গ্যাব্রিয়ানো। গত দুইদিনে আসামীর নাম শতবার উচ্চারিত হয়েছে।

- আহা,বলোই না? অবসরের বাকি আরও তিন বছর। বয়সও হলো। বুঝোইতো..

- অপরাধীর নাম লুইস গারাভিতো।

- ও আচ্ছা। চলো তাহলে শুরু করা যাক?

এ্যাডি মাথা ঝাঁকিয়ে ফাইল খুলতে শুরু করলো।
.
.
.
১৯৮৭ এর ৩'রা মে।

দুপুর দু'টো বাজে। নিজের গাড়িতে বসে আছেন মিগুয়েল নামের এক ধনকুবের। হঠাৎই এক লোক এসে মাথায় রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গাড়ির চাবি চাইলো। মিগুয়েল গাড়ির চাবি না দিয়ে চিৎকার করতে চাওয়ার আগেই ট্রিগারে চাপ পড়লো।

গুলি বের হওয়ার আগে খুনি নিজেই 'ডাকাত-ডাকাত' বলে চিৎকার শুরু করলো,লোক জমায়েত হতে হতে তিনটে গুলিও বেরিয়ে যায়,পরে শত শত লোকের ভিড়ে স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে গেলো সে।

কোনো দৌঁড়ঝাঁপের পলায়ন নয়। কেউ জানতেও পারলোনা যে খুনী তাদের মধ্যেই মিশে গেছে।
.
.
১৯৮৭ এর ২৭'শে আগস্ট।

'সি মন্টিগো' হোটেলে ভ্যালেরিয়া এই মাত্র বিছানা ছেড়ে উঠলো। লুইস নামের এই ভদ্রলোকটা বদমাশের এক হাত। এই নিয়ে দু'ঘন্টায় তিনবার করলো। তাও জোর করে।

টাকা চাইতেই লোকটা বলে উঠলো,
- কিসের টাকা?

- মানে? একবারের কথা বলে একরাতেই তিনবার মেরে দিলে। টাকা দাও,তোমার সাথে শোয়া আর সম্ভব না। এর আগেও তুমি টাকা দাওনি।

- টাকা তো নেই সোনা।

- তুমি টাকা দেবে নাকি আমি চিৎকার করে লোক ডাকবো?

লুইস হেসে বললো,
- ডাকো তাহলে?

চিৎকার করার পূর্বমুহূর্তেই ভ্যালেরিয়ার গলা চেপে ধরলো একজোড়া বজ্রমুঠি।

এক ঘন্টা পর হেলতে-দুলতে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
.
.
১৯৮৭ এর ২৫'শে নভেম্বর।

নভেম্বরের রাত। বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়েছে। সোফিয়া দ্রুতবেগে হাঁটছে। কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে তার,কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছেনা সে।

রাতের খাবার শেষে ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে উঠে এলো লোকটি। পাশে রাখা বালিশটা মুখের উপর চেপে ধরলো সর্বশক্তি দিয়ে। মিনিটখানেক পর ছুড়ি দিয়ে উদভ্রান্তের মত সোফিয়ার জামা ছিড়তে শুরু করলো খুনি। তার মুখে লেগে আছে বিকৃত এক হাসি।

এক সপ্তাহ পরে 'হেরনান হোটেল' কক্ষের ফ্রিজে রুম ক্লিনার এক তরুণীর মাথা আবিস্কার করলো। আস্তে আস্তে কাটা হাত-পা,অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেরিয়ে আসতে লাগলো।

রুম টি ভাড়া নেয়া হয়েছিলো লুইস গারাভিতো'র নামে।
.
.
১৯৮৮ এর ১৭'ই ফেব্রুয়ারি।

সেন্ট্রাল পার্কের ভেতর দিয়ে হাঁটছেন মারিয়ানা। সত্তর বছর বয়সেও দিব্যি হাঁটতে পারছেন বলে নিজের উপর বেজায় সন্তুষ্ট তিনি। দিনের বেলা জনমানুষে ভর্তি থাকে বলে সন্ধ্যার পরেই নির্জনে হাঁটতে পছন্দ করেন তিনি।

হঠাৎ করেই পেটে ধারালো কিছুর আঘাতে বসে পড়লেন মারিয়ানা। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। চিৎকার করতে চেয়েও করতে পারলেন না। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। উঠে দাঁড়াবার চেস্টা করতেই নাড়িভুড়িগুলো পেটের চেরা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তা ভরিয়ে ফেললো।

শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে ঝাপসা চোখে দেখতে পেলেন কেউ একজন নাড়িভুড়িগুলো হাতে নিয়ে মুখে পুরছে আর চিবোচ্ছে।
.
.
১৯৮৮ এর ১২'ই জুন।

প্রাইসের ডিভোর্স হয়েছে একমাস হলো। এখন নিজেকে অধিক সুখী লাগে তার। নিত্যদিন ঝগড়া-বিবাদের চেয়ে স্থায়ীভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।

দুপুরের দিকে দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দিলো প্রাইস। মাথা কামানো একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঢুকলেন ঘরে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
- ঘরে সেলাই মেশিন আর স্যুপ বানানোর কেতলি আছে ইয়াং ম্যান?

মাথা কামানো ভদ্রলোক এতক্ষণে হাঁপিয়ে গেছেন। মানুষের চামড়া এর আগে ছাড়াননি কখনো। এ ছাঁইপাশ চামড়া দিয়ে কুশন আর পাপোস হবে কি না কে জানে..!! স্যুপ-টা একটু দেখে আসা যাক।

রান্নাঘরে এসে হাসি ফুটলো তার মুখে,প্রাইসের মাথাটা বেশ ভালোই সিদ্ধ হয়েছে। মগজ-ঘিলু সব নাক,কানের ফুঁটো দিয়ে বেরিয়ে এসে পানিতে মিশে যাচ্ছে। একটু লবণ চেখে দেখা দরকার।
.
.
১৯৮৮ এর ৮'ই ডিসেম্বর।

রসায়নবিদ নিকোলাস,স্যুয়ারেজ লাইন পরীক্ষা করতে গিয়ে গলিত মাংসপিন্ড পেলেন। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন,তা এসিডে গলিত মাংসপিন্ড।

স্যুয়ারেজ পাইপ ধরে নির্জন এক রেস্ট হাউজ পর্যন্ত পৌঁছলেন তিনি। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন,গোটা বিশেক জারে হাইড্রোক্লোরিক এসিডে ডোবানো শিশুর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আস্তে আস্তে গলে গলে বিশ্রী মাংসপিন্ডে পরিণত হচ্ছে সেগুলো।

ঠিক সেই মুহূর্তেই মাথা কামানো এক মধ্যবয়স্ক লোক ঘরে প্রবেশ করলো। নিকোলাসের হাতে রডের ভারী টুকরো টা ধরা ছিলো তখনও।
.
.
.
বোগোতায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে এলো। এই শহরের ট্রেনগুলোর যাচ্ছেতাই অবস্থা।

চেয়ারে আয়েশ ভঙ্গিতে বসে আছেন এ্যাডি। তার মুখোমুখি বসা লুইস গারাভিতো।
- লুইস,তুমি কি জানো,দুনিয়ার সবচেয়ে কম শাস্তির জেলখানায় আছো তুমি?

- আমার চোখ বাঁধা ছিলো। এই জেলখানার নামই জানিনা এখনও।

- তুমি আছো কলম্বিয়ার 'লা মডেলো' কারাগারে।

- ও আচ্ছা।

- তোমার সাজা হয়েছে মাত্র ত্রিশ বছরের। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ হলে সাজা হতো নয়'শ বছরের যাবজ্জীবন।

- জানি আমি।

- আমি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই। প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে তোমার শাস্তি বাইশ বছরে নেমে আসবে।

লুইস মুখ তুলো এ্যাডির দিকে তাকালো।

- কলোম্বিয়ার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে লাশ শনাক্তের কাজ দেয়া হবে তোমায়। লাশের ব্যাপারে তোমার অভিজ্ঞতা ভালো বিধায় সরকার এ সুযোগ দিচ্ছে তোমায়। ভেবে দেখো।

- আমি রাজি।
.
.
.
জেলখানার বাইরে বেশ শোরগোল হচ্ছে। লুইস জানে,এ আন্দোলন তার বিরুদ্ধেই। কারণ,তার সাজার মেয়াদ ত্রিশ থেকে বাইশ বছর করা হয়েছে। জনগণ এ রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে আর চাচ্ছে,লুইসের জন্য নতুন করে প্রসিকিউশন করা হোক।

লুইস ভালো করেই জানে,সাইকো কিলারদের জন্য নতুন করে প্রসিকিউশন হয় না। কিন্ত আন্দোলনের মুখে সরকার রায় পাল্টাতে বাধ্য হবেই।

লুইসের বেশ হাসি পাচ্ছে এখন। জনগণ বোকা নাকি সরকার নিজেই বোকা বুঝতে পারছেনা সে।
.
.
.
তিন মাস পেড়িয়ে গেছে। লুইস এখন 'ডেথ মন্টানার' কারাগারে। কলোম্বিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার।

তোষকের নিচ থেকে "দি ডেইলি টাইটানিয়া" পত্রিকার কাটিং-টা বের করলো সে। তিনমাস আগের পত্রিকা। তাতে বড় বড় অক্ষরে ছাপানো আছে,

"লা মডেলোর কারাগারে একই সেলে ২৫জন কয়েদীর রহস্যজনক মৃত্যু এবং সাইকো কিলার লুইস গারাভিতোর পলায়ন..!!"



মরইণ্যা


- অ মইনুদ্দী,হুনছোত নি? খোকন চোরায় ত পা ভাঙছে..

- কি কও? ক্যামনে?

খানিকক্ষণ হো হো করে হেসে দম ফেললেন মকবুল মিয়া। ফিক ফিক করে হাসতে হাসতেই বললেন,
- আর ক্যামনে? ইউসুপের কব্বরের ধারে যেই খেজুর গাছ আছিলো,হেইডাত রস চুরি করতে উঠছিলো মাইজ রাইতে। রস নামানের সময় কব্বর থেইকা ইউসুপ কয়,ক্যাডায়,ক্যাডায় গাছে? আর যায় কই..!! ডর খাইয়া খোকইন্যা ধিড়িম কইরা নিচে পড়ছে।

আবারো তারস্বরে হো হো করে হেসে উঠলেন মকবুল মিয়া। সাথে মইনুদ্দীর ফোকলা দাঁতও বেরিয়ে পড়লো। দু'জন একসাথে হেসেই চলেছেন। দোকানদার রামলাল যারপরনাই বিরক্ত। কবর থেকে ইউসুফ ব্যাপারী কথা বলেছেন,সেই ভয়ে একটা মানুষের পা ভেঙ্গেছে,এতে হাসার কি আছে?
.
.
.
ইউসুফ ব্যাপারী,ধলপুরের প্রতাপশালী ব্যক্তি। প্রতাপের জোরে জায়গা দখল,লুট-পাট এমনকি খুন-খারাবি কোনো কিছুই বাদ যায়নি।

একদিন সন্ধ্যায় গাঙের ঘাট থেকে স্নান শেষে ফিরছিলো হরিমতি। ইউসুফ ব্যাপারী লোভী চোখে পথ আগলে দাঁড়ায় হরিমতির। গা বাঁচাতে সে পথের ধারে রাখা ইট টা ঠুকে দেয় ব্যাপারীর কপালে।

থানা থেকে দারোগা এসে ধরে নিয়ে গেলো হরিমতিকে। রায় যাবজ্জীবন। গ্রামের মানুষ হরিমতির পক্ষই নিয়েছিলো। ফাঁসি টা সেই সুবাদে এড়ানো গিয়েছিলো। ওদিকে ব্যাপারীর জানাযা পড়াবার মতও কেউ ছিলো না। ইমাম সাহেব আর খাদেমরা মিলে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করলেন,ব্যাপারীর বাগান-বাড়িতে।

ক'দিন পর থেকে ঘটনা শুরু। গ্রামের লোকজন বাগান-বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাতায়াতই ছেড়ে দিলো। ব্যাপারী নাকি তার কবরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে,নাচানাচি করে এমনকি কেউ কেউ কবরের উপর বসে বিড়িও ফুঁকতে দেখেছে তাকে।

"পাপী মাইনষের কব্বর,সবই আযাবের নমুনা।" রহিমা বেগমের নাতনীর কথার বেড়ে ফের প্রশ্ন,
- কব্বরের উপ্রে বইয়া বিড়ি খাওন আবার কেমন আযাব গো,দাদী?

- চুপ করতো ছেমড়ি,মাইয়া মাইনষের এত্তো জাইন্যা কাম কি?
.
.
.
মকবুল মিয়া পান চিবোতে চিবোতে চায়ের কাপ টা মুখে তুললেন।
- ধুরো লামলাল,তোমার খাছালতটাই গ্যালো না। আজকেও লিকার কম,চায়ের ত কোনো স্বাদই নাই।

- আগে পান চাবানি বন্ধ করেন। পান চাবানের সময় চা খাইলে চায়ের স্বাদ আবার পাইবেন কই?

মকবুল মিয়া আর কোনো কথা বললেন না। মইনুদ্দীর দিকে মুখ ফেরালেন।
- অ মইনুদ্দী,হুনছোত নি ঘটনা? ইউসুপের কব্বরে ত ফের আযাব ফিরছে।

- কি কও মিয়াসাব..!! ঘটনা কি?

- আর কইছ না,কাইলকা বিয়ানবেলা নাকি করিইম্যার ছোডো পোলায় আইতাছিলো বাগানবাড়ি দিয়া। দূর থেইক্যা দেহে ধোঁয়া উঠতাছে সামনে। কাছে ভিড়া দেহে,ইউসুপের কব্বরের গর্ত থেইক্যা ধোঁয়া উঠতাছে। পোলায় ত ঝাইড়া দৌঁড়,ঘরের সামনে পৌঁছাইয়াই ফিট খাই গেলো।

- আ রি মিয়াসাব,দশবছর পরে নি আবার আযাব শুরু হইলো?

- পাপের কি আর বয়স আছে রে? পাপীর পাপ,আছমার বাপ..!!
.
.
.
গফুর মোল্লা বেশ কয়েক বছর ধরেই এ পথে যাতায়াত করেন। ভূত-টূতে ভয় নেই তার। আজ পর্যন্ত ইউসুফ ব্যাপারীর কানাঘুষোর টিকিটাও দেখতে পান নি। তবে আজ কেনো জানি ভয় করছে। কবরের মাথার দিকে গর্তটা বেশ বড় হয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়,কে যেন ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কবরের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়ালেন গফুর মোল্লা। কবরের মাথার দিকে যে গর্তটা,তার পাশেই আগুন জ্বলছে। লাল,ছোট্ট একটা আগুনের কুন্ডলী লাফাচ্ছে যেন।

এ-ই তাহলে সেই,ব্যাপারীর খারাপ আত্মা। ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করলেন গফুর মোল্লা। খানিক বাদেই ঝেড়ে দৌঁড়।
.
.
.
- মইনুদ্দী রে,পাগলডারে দেখতাছি না মাসখানেক হইলো,গ্যাছে কই?

- কার কথা কন? মরইণ্যা?

- গেরামে পাগল আর আছে ডা ক্যাডায়,শুনি?

মকবুল মিয়ার এমন কথায় রামলাল মনে মনে বললো,"বুইড়া,তুমি কি সুস্থ আদমি নাকি? পান চিবানের সময় চা খাও,আবার চায়ের স্বাদও চাও।"

মইনুদ্দী শুধরালো,
- পাগল ছাগল মানুষ। কই যায়,কই থাকে,ক্যাডায় জানে..!! রামলালের ত আবার বিশাল ক্ষতি।

কথাটি বলেই হো হো করে হেসে উঠলো সে।

মরইণ্যা বাসা-বাড়ি থেকে খাবার ভিক্ষে করলেও দিনে দশটা বিড়ি নগদে রামলালের দোকান থেকে কিনতো।
রামলাল গম্ভীর স্বরে বললো,
- দোকান আমার মরইণ্যার বিড়ির নামে না,ভগবানের নামে চলে। ভগবানের কাছে ট্যাকাই মাটি,মাটিই ট্যাকা।
.
.
.
বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে,ইউসুফ ব্যাপারীর বাগান-বাড়ির সমস্যা চরমে উঠেছে। নিতান্ত বাধ্য না হলে পারতপক্ষে কেউ ওপথ মাড়ায়-ই না।

মকবুল মিয়ার আবার গল্পের খুব শখ। আজ ঠিক করেছেন ও-পথ দিয়ে বাসায় ফিরবেন। একবার পেরোতে পারলে বাজারে বেশ ঘটা করে বলতে পারবেন,ব্যাপারীর আত্মা তাকে ভয় দেখায়না,নিজেই ভয় পায়।

কবরের পাশ দিয়ে যেতেই গর্তটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। মনে হচ্ছে,কেউ যেন ভেতর থেকে তাকে দেখছে। মন প্রচন্ড বারণ করলেও একটু সাহস করে,হাঁটু গেড়ে,মাটিতে উপুর হয়ে যেই উঁকি দিবেন,অমনি কালো শীর্ণ একটা হাত খপ করে মকবুল মিয়ার হাত চেপে ধরলো।

"ও মা-গো..!!"- বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে রটে গেলো,"ব্যাপারী,মকবুল মিয়ার হাত চাইপা ধরছে।"
.
.
.
সপ্তাহখানেক জ্বর-ভোগের পর সুস্থ হয়ে আজ রাত্তিরের পান খেতে বাজারে এসেছেন মকবুল মিয়া। মইনুদ্দী পাশে নেই। একা একা রামলালের সাথে গপ-সপ করতে ভালো লাগেনা তার। রামলাল সচরাচর কথাও বলেনা তেমন।

পান চিবোনের মাঝসময়ে মইনুদ্দী হঠাৎ কোথা থেকে যেন দৌঁড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো।
- কি রে মইনুদ্দী,দৌঁড়াস ক্যান? কি হইছে?

মইনুদ্দী হাঁপাতে হাঁপাতেই উত্তর দিলো,
- মিয়াসাব,আইতাছিলাম বাগানবাড়ি দিয়া। দেহি ব্যাপারী কব্বরের উপর উইঠ্যা বিড়ি টানতাছে। আমারে কয়,ওই মইনুদ্দী,আয় বিড়ি খাইয়া যা।

- হয়তো ভুল দেখছোত।

- আরে না মিয়া,এহনও বিড়ি টানতাছে। বিশ্বাস না হইলে চলো আমার লগে?

"কি কস..!!"- বলেই মকবুল মিয়া ছুট লাগালেন। ইতোমধ্যে জনা-বিশেক লোকও জমে গেছে। তারাও পিছন পিছন ছুট লাগালো।
.
.
.
দৌঁড়োনোর সময় দূর থেকেই মকবুল মিয়া অন্ধকারে দেখতে পেলেন,একটা অবয়ব যেন কবরের উপর বসে বিড়ি ফুঁকছে। কাছে পৌঁছানোর পর দেখতে পেলেন,অবয়বটি তখনও কবরের উপর বসে বসে দিব্যি বিড়ি ফুঁকছে। ততক্ষণে বাদবাকি সবাই এসে পড়েছে।

মকবুল মিয়া ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবয়বটির উপর টর্চ ফেলতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
- কি রে মরইণ্যা? তুই এইহানে? গত দেড়মাস কই ছিলি?

মরইণ্যা এক হাসিতে সবগুলো হলুদ দাঁত বের করে উত্তর দিলো,

- ক্যান? যেইখানে বইসা আছি,এইখানেই ত ছিলাম..!!


আসছে....


(১)

নীলাদ্রি জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের বাতি নেভানো,কিন্তু সবকিছু দিব্যি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো জানালার গরাদ ঠিকরে ভেতরে ঢুকে পড়ছে। নীলাদ্রি খুব নিচু স্বরে গান গাইছে।
                   
                                       চাঁদের আলো কালো ঘরে,
                                          ঢুইকা আমায় কয়-
                                        কালো ঘরে কালো তনু,
                                         প্রাণে কি আর সয়?

কোথাও হয়তো রাতজাগা এক পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠলো। একঝাঁক বাদুড় নিঃশব্দে জ্যোৎস্নায় ছায়া ফেলে উড়ে যাচ্ছে। নীলাদ্রি গান থামিয়ে ফেললো হঠাৎ। তার কান্না পাচ্ছে। হাসনাহেনার তীব্র ঘন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।

তার মন আজ খুব খারাপ। কি কারণে খারাপ,সে জানেনা। বেশিরভাগ সময়ই অকারণে মন খারাপ হয়। নীলাদ্রি জানে,পৃথিবীর কোনো কিছুই কারণ ছাড়া হয় না। অকারণে মন খারাপের পেছনেও একটা কারণ থাকে। বেশিরভাগ সময়ই সেটা কেউ বুঝতে পারেনা,কিংবা বুঝতে পারলেও মনে করতে বা বলতে চায় না।

নীলাদ্রির ঘোর হঠাৎ কেটে গেলো। ডাইনিং রুমে চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাবা'র গলা। নীলাদ্রি জানালার কাছ থেকে সরে এলো। বাবাকে থামাতে হবে। নাহলে প্রেশার উঠিয়ে ডাক্তার-হাসপাতাল বাঁধাবে।


(২)

আকবর সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। বেশ কায়দা করে তাকে শান্ত করতে হয় নীলাদ্রির। এর আগে,রাগের কারণে চিৎকার করতে গিয়েই স্ট্রোক-টা করেছিলেন। স্ট্রোকের পর থেকে নীলাদ্রি বহু বুঝিয়ে-শুনিয়ে তবেই বাবার মাথা ঠান্ডা করে। মেয়ে ছাড়া অন্য কেউ ঠান্ডা করতে এলে এক চড়ে উল্টো তাকেই ঠান্ডা করে দেন আকবর সাহেব। এমনকি সে হোসনেআরা বেগম হলেও।

- এবার বলো বাবা,চেঁচাচ্ছিলে কেনো?

- এমনিই। তুই যা মা,ঘুমো গিয়ে।

- ঠিকাছে বাবা,আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। তুমিও শুয়ে পড়ো। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আর চেঁচামেচি করোনা। শরীর খারাপ হবে।

- ঠিকাছে রে মা,তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো গিয়ে।

নীলাদ্রি উঠে চলে গেলো। আকবর সাহেব ক্লান্তকর একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ কিসের জন্য এতো চেঁচামেচি,জানার জন্য দ্বিতীয়বার আগ্রহই প্রকাশ করলো না মেয়েটা। কোনো কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই তার। সবসময় কৌতুহল থেকে বিরত রাখে নিজেকে। এভাবে চলতে থাকলে তো একসময় জগৎ-সংসারের উপর থেকে মায়া উঠে যাবে মেয়েটার।

হোসনেআরা বেগমের মুখ থমথম করছে। খানিকটা ভীত গলায় আকবর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এখন কি করবে? দাড়োয়ানের মাথা তো মনে হয় খারাপ হয়ে গেছে।

- খারাপ হয়েছে মানে? হারামজাদা খাসা পাগল হয়ে গেছে। সকাল হলেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেবো।

- বের করে দিলে তো রাস্তায় রাস্তায়ই ন্যাংটো হয়ে ঘুরবে।

আকবর সাহেব এবার হোসনেআরা বেগমের দিকে কটমটিয়ে চাইলেন।
- তো কি করবো? বদমাশটাকে ঘরে এনে সাজিয়ে রাখবো?

- ভালো দেখে কোনো একটা মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও?

- আমার অত ঠ্যাকা নেই। বের করে দেবো। যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে গিয়ে ন্যাংটো হয়ে বসে থাকুক।


(৩)

সকাল আটটা বেজে গিয়েছে। নীলাদ্রি তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলো। ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে আর আধঘন্টা পরেই।
দরজা দিয়ে বেরোবার সময়ই লম্বা এক স্যালুট ঠুকলো ইসমাইল। সবগুলো দাঁত বের করে,বিশাল হাঁ করা এক হাসি দিয়ে ডগমগে গলায় বলে উঠলো,
- কাল রাইতে স্যার যা কইছে,সত্যি ছিলো আপা। কিন্তু আমার তাতে দোষ নাই। কি করমু আপা,কন? যা গরম পড়ছে,গতরে কাপড় রাখাই দায়..!!

নীলাদ্রি বলে উঠলো,
- মানে? বুঝলাম না।

- থাক আফা,বুঝন লাগতোনা। যেইখানে যাইতাছিলেন,যান।


(৪)

ম্যানেজার মাইনুর কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন ইলিয়াস সাহেবের সামনে। ইলিয়াস সাহেবের মাথায় আইসব্যাগ ধরে রাখা হয়েছে।

ইলিয়াস সাহেবের অফিসে পোষা একটা ময়না ছিলো। কটকট করে কথা বলতে পারতো। কোনো একটা শব্দ দু'তিন দিন ক্রমাগত শুনতে থাকলে অতি দ্রুত সে শব্দ লুফে নিতে পারে ময়না পাখিরা।

ইলিয়াস সাহেব সারাক্ষণই অফিসে 'মাইনুর-মাইনুর' করতেন। পাখিটাও কেনার এক সপ্তাহের মাথায় কথা বলতে শুরু করে। ম্যানেজার মাইনুর রুমে ঢুকলেই ময়না বলে উঠতো,
- মাইনুর তোর নাম কি? মাইনুর তোর নাম কি?

জবাব না দিলে চিৎকার ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকতো।

ইলিয়াস সাহেব ইদানীং অফিসে যাচ্ছেন না। ছোট ছেলের জন্য বিয়ের পাত্রী দেখছেন। মহাযজ্ঞীয় ব্যাপার..!! ম্যানেজারও এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ময়না পাখিটাকে দিয়ে গিয়েছিলেন অফিসের ড্রাইভার-গার্ডদের মেসে'তে। ফিরে এসে ময়না পাখিকে দেখেই চক্ষু চড়কগাছ..!! এ ময়না আর আগের ময়না নেই। যে'ই সামনে আসছে,ময়নার মুখে একটাই কথা,
- নটির পুত তোর নাম কি? নটির পুত তোর নাম কি?

সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হচ্ছে,পাখিটা ইলিয়াস সাহেবকে দেখার পর থেকে অনবরত এ কথা বলেই যাচ্ছে। ম্যানেজার মাইনুর সারা দিন-রাত চেষ্টা করেও পাখির মুখে অন্য কোনো বুলি ফোটাতে পারছেন না।


(৫)

ইলিয়াস সাহেব বাসায় ঢুকেই রাহেলা বেগমকে ডাকলেন।
- হারামজাদা কি এখনও ঘুমোচ্ছে?

- না,নাস্তা করে বেরিয়েছে।

- তা তো বেরোবেই। অকর্মাদের তো একটাই কাজ,ধ্যাই ধ্যাই করে ঘোরা। তা তোমার বড় পুত্তুর কোথায়? সেও কি ঘুরে বেড়াচ্ছে?

- সে কি? ও না তোমার সাথে অফিসে গেলো?

- হবে বোধহয়,ভুলে গেছি। এক কাপ চা আনো।


(৬)

ইলিয়াস সাহেবের বড় ছেলে যায়েদ। একমনে ফাইলপত্র সই করে চলেছে। সামনের চেয়ারে যে সায়েদ বসে আছে,ভ্রূক্ষেপই নেই।

- এ্যাই দাদা,পালিয়ে যে বিয়ে করেছিলি,ফিলিংস কেমন ছিলো রে?

- হুঁ? কিছু বললি?

- বললাম যে,পালিয়ে বিয়ে করতে অনুভূতি কেমন?

যায়েদ ফাইলপত্র থেকে মুখ তুললো,মুখটা হাসিতে ভরে উঠেছে।
- সত্যি বলবো?

- আমি কি মিথ্যাটা জানতে চেয়েছি?

- অসাধারণ অনুভূতি,পুরো এ্যাডভেন্ঞ্চার..!!

- আর বাসায় ফেরার পর বউয়ের সামনে যে বাবার হাতে থাপ্পড়,সেটা?

যায়েদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার ফাইলে মুখ গুঁজলো।
- তুই আমার রুম থেকে বেরো।

- কেনো? সমস্যা কি?

- বের হতে বলেছি,বেরো। নাহলে ম্যানেজারকে ডেকে বের করে দেবো।

- কাউকে বের করতে হলে গার্ডকে ডাকতে হয়। ম্যানেজারকে নয়।

- তুই যাবি?

- ঠিকাছে,যাচ্ছি তো।

দরজার সামনে গিয়ে সায়েদ আবার ঘুরে দাঁড়ালো।
- আমারও পালিয়ে বিয়ে করার শখ ছিলো। কিন্তু বাবার চড়ের ভয়ে শখ টা আর মিটলোনা।


(৭)

সায়েদ বড় ভাইয়ের রুম থেকে ম্যানেজার মাইনুরের রুমে ঢুকলেন। ম্যানেজার তখনও ময়না কে বুলি পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। সায়েদকে দেখে ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
- কেমন আছেন মাইনুর সাহেব?

- জ্বী ভাইজান,ভালো।

- আপনি আমার বড় ভাইকে স্যার বলে ডাকেন,আমাকে ভাইজান ডাকেন কেনো?

ম্যানেজার অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
- না মানে,আপনি তো অফিসে বসেন না,তাই আর কি..

- শোনেন ম্যানেজার সাহেব,গরুর পুত্র গরুই হয়,বসের পুত্র বস ই হয়।

- জ্বী ভাইজান,আজ থেকে স্যার বলে ডাকবো।

- প্রয়োজন নেই,ভাইজান ই ডাকবেন। গরুর উপমা আমার জন্য প্রযোজ্য না।

- জ্বী ভাইজান,তা তো অবশ্যই।

সায়েদ কতক্ষণ ময়না পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঘুরে চলে যাবে এমনসময় বলে উঠলো,
- আচ্ছা মাইনুর সাহেব,ময়না পাখির মাংস কি খাওয়া যায়?

- জানি না ভাইজান। কেনো?

- খাওয়া গেলে এটাকে রোস্ট বানিয়ে খেয়ে ফেলুন। মিনিটে তো বোধহয় শ'খানেক গালি দিচ্ছে..


(৮)

নীলাদ্রির মন আজ একটু বেশিই খারাপ। পূর্ণিমার শেষ কয়দিনে যখন আলোর ভাটা পড়তে শুরু করে,তখন ও ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। অন্ধকার যেন ওর গায়ের রং-কে আরো গাঢ় করে তোলে। হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গন্ধটা যেন প্রভাবকের কাজ করছে। নাক দিয়ে বুকের ভেতরে ঢুকে চাপা কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নীলাদ্রির অতি পছন্দের সেই লাইনগুলো এখন বড্ডো মনে পড়ছে। সে মিনমিন করে লাইনগুলো সুরে তোলার চেষ্টা করলো-

                                         ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া-
                                           জ্যোৎস্না ধরতে যাই;
                                      আমার হাত ভর্তি চাঁদের আলো,
                                           ধরতে গেলেই নাই..!!

সুর টা হঠাৎ থেমে গেলো। নীলাদ্রির চোখে কিছু একটার নড়াচড়া ধরা পড়ছে। ওর জানালাটা বাসার পেছনের বাগানমুখী। জায়গাটা জংলামত,ঘাসে ভর্তি,বেশ রকমের গাছও আছে। পরিস্কারের অতি প্রয়োজন না পড়লে সচরাচর কেউ যায় না,এত রাতে তো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া স্ট্রীট ল্যাম্পের আবছা আলোয় সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্তই বাগানে আলো-আঁধারীর খেলা চলে যেন।

নীলাদ্রি জানালা দিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। একজন মানুষের ছায়াকে দেখা যাচ্ছে,মনে হচ্ছে হাঁটছে। দূরে কোথাও রিক্সার ক্রিংক্রিং শব্দ হলো। নীলাদ্রি বিদ্যুৎবেগে জানালা থেকে সরে এলো।

লোকটি অন্ধকার থেকে আবছা আলোতে এসেছে,চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গায়ে কোনো কাপড় নেই..!!

(এখনও ইচ্ছে করেই শিরোনাম দিইনি গল্পটির,হয়তো কোনো একদিন বাকী অংশটুকু লিখে শিরোনাম দেবো। এটুকু পড়ার পর খেপে যাওয়া,পড়তে ইচ্ছুকগন,ইনবক্স কিংবা কমেন্টে গালাগালি করতে পারেন। আমার গল্পের পাঠক আবার খুবই কম। গালাগালির পরিমাণও তাই শূন্য।)





হ্যাংলা দা


- কখনো মড়া পুড়িয়েছিস,নিতাই?

- মড়া? ঢের পুড়িয়েছি। এই গেল হপ্তায় ই তো নিবারণ কাকুর মড়া পোড়ালাম।

সুদেব যেন একটা ধাক্কা খেলো। ভারী একটা অবাক চোখে নিতাইর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কি বলিস? কিভাবে?

- আর বলিস না। অম্বল হয়েছিলো। বেচারা সারাজীবন অন্যকে অম্বলের অষুধ দিয়ে শেষমেষ কিনা নিজেই মরে গেলো,আহারে..!!

- তবে হ্যাংলা দা যে আমায় কিচ্ছুটি বললোনা?

এবার নিতাই যেন একটা ধাক্কা খেলো। ভারী অবাক চোখে সুদেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
- হ্যাংলা দা? কোথায় পেলি তাকে?

- কেনো? সে ই তো আমাকে নদী পার করে দিলো। হ্যাংলা দা না থাকলে এই শীতের রাত্তিরে নৌকো যে কোথায় পেতাম,ভেবেই দায়।

নিতাই যেন কথাটা বিশ্বাস করলো না। ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- তুই সত্যি বলছিস তো সুদেব?

- ভারী আজিব..!! মিথ্যে বলতে যাবো কোন সঙে? হ্যাংলা দা এর মত ভালো ছেলে এই তল্লাটে দ্বিতীয়টা আছে নাকি যে মিথ্যে বলতে যাবো?

নিতাই হাত বাড়িয়ে বললো,
- তবে আমায় ছুঁয়ে বল?

সুদেব একটু বিরক্তির সাথে নিতাইর হাত ছুঁয়ে বললো,
- হারামজাদা,এই নে,তোর হাত ছুঁয়েই বলছি।

নিতাই হাঁটার মাঝেই থমকে দাঁড়ালো।

- কি রে,থামলি কেনো? কত দূর পথ বাকি। ভাগ্যিস মাঝপথে তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। নইলে এই নিশি রাত্তিরে একা একা পথ যেতে ভীষণ বাজে লাগতো। যদিও হ্যাংলা দা কে বলেছিলাম,বাড়ি পর্যন্ত আমার সাথেই যেতে। বললো,তার নাকি বাজারে কি সব কাজ আছে।

নিতাই শান্ত স্বরে বললো,
- সুদেব,চুপ কর। হ্যাংলা দা দিন পনেরো আগে মারা গেছে।

সুদেব খানিকক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে উঠলো।
- ঢপ মারছিস হারামজাদা..!! হ্যাংলা দা মরে গেলে আমায় নদী পার করে দিলো কে? তোর শ্বশুরমশাই?

- আমি কিন্তু সত্যি বলছি সুদেব।

- ধুর,ঢপ মারছিস। আচ্ছা,গা ছুঁয়ে বল দেখি?

নিতাই সুদেবের গা ছুঁয়ে বললো,
- সত্যি বলছি। গত মাসের শেষের দিকে ট্রেনে কাটা পড়ে মরে গেলো। আমি নিজে কালীঘাটের চিতায় উঠিয়েছি।
সুদেবের মাথাটা ঝিঁ ঝিঁ করছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো দরকার।
.
.
.
সুদেব শুয়ে আছে। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বোধহয় জ্বর আসছে। ভয়ে নাকি নদীর ঠান্ডা হাওয়ায়,ধরা যাচ্ছেনা। তবে ঠান্ডা হাওয়ার জন্যই হবার সম্ভাবনা বেশি। হ্যাংলা দা'র ঘটনা জানার পর বিষম খেলেও ততটা ভয় পায়নি। ছোটবেলা থেকেই সুদেব কিছুটা সাহসী।

ঠাকুর'দা একবার বলেছিলেন,"সুদেব নামটাই পূণ্য। নামের মধ্যে একটা দেবতা দেবতা ভাব আছে। আমার নাতিকে কোনো শয়তান ভয় দেখাতে আসলে মুন্ডি কেটে রেখে দেবে।"

যদিও সুদেব বয়স পাঁচেক সময় হিজলতলায় হামা ভূতের চড় খেয়েছিলো। চড় খাওয়ার পরপরই হিজলতলার সব গাছ কেটে ফেলা হলো। বাবু বংশের ছেলের গালে চড়? ভূতদের গুষ্টিই উঠিয়ে দেবো ক্ষণ..!!

সুদেব অনেক চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছেনা। শুয়ে শুয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগলো শুধু। ডানদিকে চোখ পড়তেই চোখ কুঁচকিয়ে ফেললো। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। আবছা আলোতে বেশখানেক সময় তাকিয়ে থাকার পর বুঝলো,কে যেনো পড়ার টেবিলের চেয়ারটা ঘরের মাঝে এনে তাতে বসে আছে।

অবয়বটা উঠে দাঁড়ালো। হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোতে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে,একটা ছেলে। ছ'ফুটখানেক লম্বা,টিঙটিঙে শরীর,অন্ধকারের কালো রংয়ের মাঝে অবয়বটা আরও গাঢ় কালো হয়ে আছে। কালো শরীরে ধূসর রংয়ের ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ভারী ঢিলেঢালা একটা গেন্জি পরনে।

অবয়বটা ঠায় চেয়ার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে। সুদেব বিছানায় উঠে বসতে বসতে যেন অবয়বটাকে খানিকটা চিনতে পারলো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,"হ্যাংলা দা?"

বলতে বলতেই ধপ করে ফের বিছানায় পড়ে গেলো সে।
.
.
.
নিতাই খেতে খেতে ছ্যাঁক করে উঠলো।
- দেখ দেখ সুদেব,পড়লো তো পড়লো,আমার মুখেই পিত্তি টা পড়লো..!!

সুদেব চুপচাপ খেয়ে চলেছে। গায়ের জ্বর ভীষণ বেড়েছে। মা বলেছিলো,ঘর থেকে বেরোতে না। কিন্তু সুদেবেরও আবার ঘরে মন টেকে না। পাছে নিতাই,ভাজা ইলিশের নেমন্তন দিলো।

- বুঝলি সুদেব,মাছের পিত্তি মুখে পড়লেই মুখটা বেস্বাদ হয়ে যায় রে। মানুষের পিন্ডিরও একই কাহিনী। সেদিন কি হয়েছিলো জানিস? হ্যাংলা দা'র মড়া পোড়াচ্ছি,হঠাৎ করে কি যেন 'টাস্' করে উঠলো। দেখি আমার মুখে ছিটছিটে পোড়া মাংসের টুকরো। আমি তো যা ভয় পেলাম..!! অম্বিকা কাকু বললো,ভয় পাসনে,ওটা পিন্ডি ফেটেছে।

নিতাই হো হো করে হাসছে। সুদেব খাওয়া বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। হাত ধুতে কলপাড়ে যেতে হবে। শরীরটা বেজায় ভার লাগছে।

কল চেপে হাত ধুতে ধুতে যেই-ই সুদেব ঘাড় উঠিয়েছে,দেখে হ্যাংলা দা দাঁড়িয়ে। ছ'ফুটখানেক লম্বা,টিঙটিঙে শরীর,মিশকালো গায়ের রং। কালো শরীরে ধূসর রংয়ের ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ভারী ঢিলেঢালা একটা গেন্জি পরনে।

সুদেবের চোখের পলক পড়ছেনা,বোধহয় দৃষ্টিভ্রম। হ্যাংলা দা বলে উঠলো,
- জানিস রে সুদিব? ঝুড়িবোঝাই করে ইলিশ মাছ নিয়ে যাচ্চিলাম বাজারে,হঠাত করি রেলে পা আটকে গেলো। কত তড়পালাম,ছাড়লোই না..!! পিছ ফিরতেই দেখি ট্রেনমামা ঘটঘট করি চলে গেলো উপর দিয়ে।

সুদেবের গা শিরশির করে উঠলো। হ্যাংলা দা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সুদেব চোখ ডললো। দৃষ্টিভ্রম গেলো না। হ্যাংলা দা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জ্বর বোধহয় বেশ বেড়েছে। চোখের ধাঁধা তাই গেড়ে বসেছে।

সুদেব উঠে দাঁড়ালো পেছন ঘুরে। বাড়ি গিয়ে একটা কষে ঘুম দিতে হবে। পেছন থেকে হ্যাংলা দা যেন বলে উঠলো,
- আমি ইলিশ মাছ নিয়ে ট্রেনে কাটা পড়লাম,আর তুই আমায় দেখে সেই ইলিশ খেতে পারলি না। সুদিব রে,ইলিশ আর খাস নে। তুই না আমায় কত ভালো পেতি?
.
.
.
নিতাই সুদেবকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
- এত কষ্ট করে বৌদিকে দিয়ে তোর জন্য মাছ ভাজালাম,তুই তো একটাও খেতে পারলি না। জ্বর কি খুব বেশি?
সুদেব গোঁ করে উঠলো,

- হুম।

- আচ্ছা সুদেব,বলতো দেখি,ইলিশ মাছের গায়ের রং এমনতর হয় কেন?

সুদেব বললো,জানিনা।

নিতাই কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
- কাউকে বলিস না। হ্যাংলা দা বলেছিলো। আমরা দশমীতে যেই দুর্গাকে ভাসিয়ে দিই,অমনি ইলিশেরা সেইদিন ঝাঁক বেঁধে মায়ের মাটি খায়,অলংকার খায়। তাই নাকি ইলিশের রং এত খোলতা হয়..!!

সুদেবের মাথায় কিছু ঢুকছেনা। হাজার হাজার মাছি যেন মাথার ভেতর ভনভন করে ঘুরছে।
.
.
.
ঘুম ভাঙতেই সুদেব উঠে বসলো। শরীরটা এখন একটু হালকা লাগছে। তিন বছর পর বাড়ি এসে নিজের ঘরটাকেও ভালমত দেখা হয় নি। মা এসে চালভাজা দিয়ে গেলো।

- বাপধন,যা জ্বর বাঁধিয়েচিস..!! চালভাজায় পেঁয়াজ মরিচ দিয়েচি। চাবা বসে বসে,স্বাদ জুটবে।
সুদেব মাথা নেড়ে চালভাজার দিকে হাত বাড়াতেই দেখে,সামনে বসে হ্যাংলা দা দিব্যি চালভাজা চিবোচ্ছে।

- বুঝলি রে সুদিব,মরে যাওয়ার পর কিচ্ছুটি খেতে পারি নে। সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। এই দেখ,তোর মনে হচ্ছে চাল চিবোচ্ছি,আসলে কিন্তু চিবোচ্ছি না। হো হো..

সুদেবের ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দেয়। কিন্তু তা করা সম্ভব হচ্ছে না কেন যেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
- তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেনো,হ্যাংলা দা?

- সে কি রে..!! তুই না আমার জাতভাই? তোর কাছে আসবো না তো কি নিতাইর কাছে যাবো?

- তুমি না মরে গেছো? দুনিয়াতে থেকে আর কাজ কি?

- স্বাদে কি আর থাকি রে? নিবারণ কাকু মরলো,তিনকূলে কেউ ছিলো না। কবিরাজ বলে সায়েবের লোকেরা মস্ত বড় ভুজ্যি দিলো। সায়েবের ছেলে মুখাগ্নি দিলো। বলি আমার থেকেই তো সব ইলিশ নিতি,দামও দিতি না ঠিক করে। আমারও তো তিনকূলে কেউ নেই। ওরা কি পারতো না আমার নামে একটা ভুজ্যি দিতে? গাঁয়ের লোকের কম উপকার করেছি আমি? ঘর পাহাড়া,খেত নিড়ানো,গরু ধরে দেয়া,কম কাজ করেছি? শালা শুয়োরের দল।

সুদেব ঘোঁৎ করে উঠলো।
- ভুজ্যি না দিলে স্বর্গে যাওয়া যায় না বুঝি?

- সে তো জানি নে। তবে আমায় যে যেতে দিচ্ছে না।

সুদেবের মনে হচ্ছে,তার মাথাটা গেছে। নাহলে চোখের সামনে মরে যাওয়া মানুষ জমিয়ে আড্ডা দেয় কিভাবে..!!
.
.
.
দিন চারেক পেরিয়ে গেলো। সুদেব উঠতে বসতে হ্যাংলা দা কে দেখতে পায়। হয়তো মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে চোখ মেলে তাকিয়েছে,দেখা গেলো হ্যাংলা দা মশারির উপর শুয়ে আছে নয়তো কড়িকাঠ ধরে ঝুলে আছে। ভোরবেলা কলপাড়ে গিয়ে দেখা গেলো,সে আগে থেকেই কয়লা তুলে দাঁত মাজছে।

- ভূতদের আবার দাঁত মাজা লাগে নাকি,হ্যাংলা দা?

- শখের বশে মাজি আর কি। দেখতো,এই দাঁতটা পরিষ্কার হয়েছে কি না?

এই বলে হাত দিয়ে একটা দাঁত খুলে সুদেবের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

সুদেব বুঝতে পারছে না কি করবে। হ্যাংলা দা পিছু ছাড়ছে না। মরে যাওয়া মানুষ পিছু পিছু ঘুরলে নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। হাজার হলেও সুদেব শহরে থাকে,বাস্তবতা আছে একটা।
.
.
.
সেদিন মাঠে বসে সুদেব প্রক্ষালন সারছে,পাশে তাকিয়ে দেখে হ্যাংলা দা-ও সেভাবেই বসে আছে। সুদেব ফিক করে হেসে বললো,
- ভুতরা শুধু খেতে পারে জানতাম,হাগতেও পারে,জানতাম না তো হ্যাংলা দা।

হ্যাংলা দা নদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
- সুদিব,ভুতরা সব পারে। আর আমি তো সেই ধরনের ভুত না। ভুজ্যির জন্য শুধু আটকে আছি।

- তুমি তো পুরো খাসা জিনিস..!! ভুজ্যি ছাড়া চলে যাওনা ওপারে,সমস্যা কি?

- না রে সুদিব,যাবো না রে। দে না সুদিব,দে না? আমার নামে একটা ভুজ্যিই তো। আমিও স্বর্গে যেতে পারি তাহলে।
সুদেব উঠে দাঁড়ালো। কম্ম সাবাড় হয়েছে।
.
.
.
নিতাই চোখ কপালে তুলে বললো,
- কি রে সুদেব,একদম সুস্থ মনে হচ্ছে? যা জ্বরে পড়েছিলি,ভাবলাম একমাসের আগে তো উঠতেই পারবি না।

- বাদ দে ওসব। চল আমার সাথে।

- কোথায় যাবো?

- বামুন ঠাকুরের বাড়ি।

- কেনো রে? পূজা লেগেছে নাকি তোর বাড়ি?

সুদেব উত্তর দিলো,
- আরে না। গায়ে একটা ভুজ্যি উচ্ছুগ্গু না দিলে চলে কেমন করে? শালা নামেও হ্যাংলা,কাজেও হ্যাংলা..!!